আমি জানি মায়ের দুধই শিশুর জন্য সবচেয়ে ভালো। তারপরও আমি বাধ্য হয়ে আমার বাচ্চাকে ফর্মুলা মিল্ক দিই, কারণ চাহিদা পূরণ হওয়ার মতো পর্যাপ্ত দুধ ও আমার কাছ থেকে পায় না।
কথাগুলো বলছিলেন দিল্লির এক তরুণী মা প্রণিতা; যিনি মাস চারেক আগে একটি ছেলে সন্তানের জন্ম দেন। এটাই তার প্রথম সন্তান। তিনি তার শিশুকে ফর্মুলা দুধ খাওয়ান কারণ শিশুর চাহিদা অনুযায়ী তার পর্যাপ্ত দুধ নেই। তার সমস্যার যাতে সমাধান করা যায়, সে জন্য চিকিৎসকের সাহায্যও নিচ্ছেন তিনি।
প্রণিতার আফসোস শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর বিষয়ে তার বেশি কিছু জানা ছিল না এবং শিশুর জন্মের পরপরই বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর বিষয়ে নার্স তাকে খুব বেশি সাহায্য করেননি।
উল্টো দিকে নীতিকা নামে আরেক মা বলছেন, তিনি তার বাচ্চাকে ৬ মাস ধরে বুকের দুধ খাওয়ান, যে কারণে তিনি শিশুর বিকাশ সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সুপারিশ ০-৬ মাস বয়সী শিশুকে কেবল মায়ের দুধ খাওয়ানো উচিত। তবে এখনও আমাদের চারপাশে বুকের দুধ খাওয়ানো এবং বুকের দুধ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অনেক সময় এমন কিছু কথা বলা হয়, যার কোনো ভিত্তি নেই।
ডব্লিউএইচও এ সম্পর্কে সচেতনতামূলক প্রচারাভিযান পরিচালনা করে এবং এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ।
বুকের দুধ সম্পর্কে তথ্যের অভাব নেই। হাসপাতাল, চিকিৎসাকেন্দ্রসহ অনেক জায়াগাতেই এর প্রয়োজনীয়তার কথা বর্ণনা করে পোস্টার লাগানো দেখা যায়।
চিকিৎসকরাও জোর দিয়ে বলেন, সন্তান জন্মের পরপরই তাকে মায়ের হলুদ ঘন দুধ খাওয়ানো উচিত, কারণ এতে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। কিন্তু অনেক সময় সঠিক তথ্যের অভাব ও সহযোগিতার অভাবে মায়েরা বুকের দুধের বিকল্প হিসেবে ফর্মুলা মিল্ক ব্যবহার করেন।
অনেক মা আবার অভিযোগ করেন, তাদের পর্যাপ্ত দুধ নেই, যার কারণে বাধ্য হয়ে ফর্মুলা মিল্ক ব্যবহার করতে হয়।
ফর্মুলা মিল্ককে বেবি ফর্মুলাও বলা হয়। এটা সাধারণত গরুর দুধ থেকে তৈরি করা হয়। শিশুর জন্য উপযুক্ত করে এটা তৈরি করা হয়।
বুকের দুধের বদলে অনেক শিশুকেই ফর্মুলা মিল্ক খাওয়ানো হলেও শিশুর স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনায় নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বুকের দুধ খাওয়ানোকে শিশুদের জন্য আদর্শ খাদ্য হিসাবে বিবেচনা করে। বুকের দুধ খাওয়ানো এবং ফর্মুলা মিল্ক নিয়ে বহু ধরনের কথা প্রচলিত রয়েছে লোকমুখে। সঠিক তথ্য ও জানাশোনার অভাবে বহু মানুষ সেসবে বিশ্বাস করেন।
এরকম কিছু প্রচলিত ভুল তথ্য হলো-
• ফর্মুলা মিল্ক শিশুর বিকাশকে উন্নত করে।
• ফর্মুলা মিল্ক শিশুকে ক্ষুধার্ত রাখে না।
• ফর্মুলা মিল্কে শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিটি পুষ্টি উপাদান রয়েছে।
• ফর্মুলা মিল্কে বুকের দুধের মতো একই সুবিধা রয়েছে। বুকের দুধে শিশুর পেট ভরে না।
• বুকের দুধ পান করলে তা মাকে দুর্বল করে দেয়।
এ বিষয়ে ভারতের একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ভাটসালা দাধওয়াল বলেন, একজন মা তার সন্তানকে তার সেরাটি দিতে চান। সব মায়েরাই এটা জানেন যে, বুকের দুধ খাওয়ানো শিশুর জন্য ভালো। সমস্যাটা হলো এর সঙ্গে তাদের কাছে থাকা একটি ভুল তথ্য। তারা ধরে নেন যে, বুকের দুধ তার শিশুর জন্য যথেষ্ট নয়।
‘অবশ্যই, মায়ের দুধ প্রথম অগ্রাধিকার, কারণ এটা বিশেষভাবে শিশুর জন্য তৈরি। ফর্মুলা মিল্ক এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে বুকের দুধে থাকা উপাদানগুলো সেখানে পাওয়া যায়।’
তিনি আরও বলেন, প্রোটিন এবং কার্বোহাইড্রেট দু’রকম দুধেই থাকে। কিন্তু বুকের দুধে থাকা প্রোটিনটি সহজে হজমযোগ্য। এটি শিশুকে সহজেই দুধ হজম করতে সহায়তা করে এবং তার কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা হয় না।
তিনি আরও বলেন, এ ছাড়াও বুকের দুধে এমন কিছু উপাদান থাকে, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। সংক্রমণ প্রতিরোধ করে। এই ক্ষমতা ফর্মুলা দুধে নেই। এছাড়াও বুকের দুধে কিছু ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে যা শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং বুকের দুধে যে ভিটামিনগুলো থাকে তা প্রাকৃতিক আর ফর্মুলা মিল্কে সিন্থেটিক থাকে।
অনেকের বিশ্বাস যে ফর্মুলা মিল্ক শিশুর বিকাশ দ্রুততর করে। এ বিষয়ে একজন চিকিৎসকের বক্তব্য হলো- মোটেও তা নয়।
তিনি বলেন, এটা একটা ভুল ধারণা। আসলে ০-৬ মাসের মধ্যে, শিশুর মায়ের দুধ ছাড়া অন্য কিছুর প্রয়োজন হয় না, তাদের জন্য এটাই পুরো ডায়েট। দেখা গেছে, যে শিশুদের বুকের দুধ খাওয়ানো হয়েছে, তাদের দীর্ঘমেয়াদে স্থূলতার সমস্যা কম। আর যে শিশুদের ফর্মুলা দুধ দেওয়া হয়, তাদের ওজন একটু বেশিই বেড়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, সেই সঙ্গে বুকের দুধ খাওয়ানো ডায়রিয়ার মতো রোগকে দূরে রাখে। যে শিশুরা বুকের দুধ খায় তাদের মধ্যে বুকের সংক্রমণ বা কানের সংক্রমণ কম দেখা যায়।
শিশুর জন্য মায়ের দুধ যেমন জরুরি, শিশুকে স্তন্যপান করানো মায়ের জন্যও জরুরি। ওই চিকিৎসক বলেন, এটা শুধু পুষ্টির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। যে মা তার শিশুকে স্তন্যপান করাচ্ছেন, তাকে নিজের কাছে রাখলে শিশুর মায়ের সঙ্গে মানসিক সম্পর্ক দৃঢ় হয়। শিশুটি কম কান্নাকাটি করে।
তিনি আরও বলেন, গর্ভাবস্থায় মায়ের ওজন বৃদ্ধি পায় এবং যখন মা তার শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো শুরু করেন, তখন এটা ওজন হ্রাস করতেও সহায়তা করে।
তার মতে, বাচ্চা যখন ক্ষুধার্ত থাকে, তখন আপনি বুকের দুধ খাওয়াতে পারেন। জন্মের পর প্রথম কয়েক দিন শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে শিখতে সময় লাগে, এমন পরিস্থিতিতে অল্প ব্যবধানে দুধ খাওয়াতে হতে পারে কিন্তু ধীরে ধীরে তিন-চার ঘণ্টার একটি চক্র তৈরি হয়। এমনকি রাতেও, মাকে কমপক্ষে দুইবার শিশুকে খাওয়াতে হবে।
অনেক সময় এমন হয় যে, সন্তানের প্রয়োজন অনুযায়ী মায়ের দুধ নেই, তখন মায়ের উচিত প্রথমে খাবারে পুষ্টির পরিমাণ বৃদ্ধি করা। পানি খাওয়ার পরিমাণ বাড়াতে হবে এবং বাড়তি চাপ নেওয়া যাবে না।
এ ছাড়া কিছু ওষুধও আছে যা এ সময়ে কার্যকরী হতে পারে। এর পরেও সমস্যা হতে পারে, তবে শিশুকে পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে! এই অবস্থায় শুধুমাত্র চিকিৎসকের পরামর্শে ফর্মুলা মিল্ক দেওয়া যেতে পারে।
ফর্মুলা মিল্কের ক্ষেত্রে এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, সেখানে দুধ ও পানির যে অনুপাতের কথা উল্লেখ থাকে দুধ বানানোর সময় তার জন্য পরিবর্তন না করা হয়। কারণ বেশি পানি যোগ করলে শিশু প্রয়োজনীয় পুষ্টি নাও পেতে পারে। যারা যে পানি ব্যবহার করা হচ্ছে তা ভালো করে গরম করে তারপর ঠান্ডা করে ব্যবহার করুন। বোতল বা বাটি-চামচের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। এগুলো না করা হলে শিশুর ডায়রিয়া হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
ইউনিসেফের মতে, যেসব শিশুকে শুধু বুকের দুধ খাওয়ানো হয়, তাদের এমন শিশুদের তুলনায় মারা যাওয়ার আশঙ্কা ১৪ গুণ কম যাদের বুকের দুধ খাওয়ানো হয় না। তবে বিশ্বব্যাপী বর্তমানে মাত্র ৪১ শতাংশ শিশুকে ০-৬ মাসের মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানো হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্য দেশগুলো ২০২৫ সালের মধ্যে এ হার কমপক্ষে ৫০ শতাংশে উন্নীত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ডব্লিউএইচও এবং ইউনিসেফের মতে, শিশুদের তাদের প্রথম ৬ মাসে মায়ের দুধ ছাড়া অন্য কিছু দেওয়া উচিত নয়, এর পরে তাদের ২ বছর বা তার বেশি বয়স পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যাওয়া উচিত এবং সঙ্গে অন্যান্য পুষ্টিকর এবং নিরাপদ খাবার দেওয়া উচিত।
কবে থেকে এবং কেন বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ পালিত হয়?
এটা ১৯৯২ সালে শুরু হয়েছিল এবং প্রতি বছর ১ থেকে ৭ আগস্টের মধ্যে পালিত হয়। প্রকৃতপক্ষে, ১৯৯০-এর দশকে ‘বুকের দুধ খাওয়ানো : একটি গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ’ শীর্ষক একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের কর্মকর্তারা এবং সদস্য দেশগুলোর কর্মকর্তারা এতে উপস্থিত ছিলেন। বুকের দুধ খাওয়ানো যে শিশু এবং মা উভয়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়ার অংশ, সে বিষয়টা ওই সভায় তুলে ধরা হয়।
বুকের দুধে শিশুর বিকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রয়েছে। বিশ্বাস করা হয় যে, বুকের দুধ খাওয়ানো কেবল শিশুর স্বাস্থ্যের জন্যই ভালো নয়, মায়ের সুস্থ থাকার ক্ষেত্রেও এর ভূমিকা রয়েছে। এটি স্তন এবং জরায়ুর ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করে।