রংপুরের আলুচাষিরা এখন ফুরফুরে মেজাজে। একদিকে আলুর বাম্পার ফলন, অন্যদিকে বিদেশে বেড়েছে আলু রপ্তানি। কিছুদিন আগেও আলু নিয়ে চিন্তায় থাকায় চাষিরা এখন খেত থেকে আলু উত্তোলনে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
সম্প্রতি রংপুর থেকে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আবর, নেপাল, শ্রীলঙ্কাসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আলু পাঠানোর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এবার প্রথমবারের মতো রাশিয়াতেও যাচ্ছে এখানকার আলু। রপ্তানি বাড়ায় স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন চাষি ও ব্যবসায়ীরা।
উন্নত পদ্ধতিতে আলু উৎপাদন ও ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতকরণে সরকারের এ উদ্যোগ কৃষক এবং রপ্তানিকারকদের আশান্বিত করেছে। গত ১৯ মার্চ শনিবার মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দ ইউনিয়ন এবং ১৫ মার্চ পীরগাছার পারুল ইউনিয়ন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আলু রপ্তানি শুরু হয়েছে। আর কিছুদিন পরে আলু উত্তোলন শেষ হলে পুরোদমে চলবে বস্তাবন্দি আলুর বিদেশযাত্রা। নিজেদের জমির উৎপাদিত আলু বিদেশে রপ্তানির সুযোগ পেয়ে খুশি কৃষকরা।
মিঠাপুকুরে আলু রপ্তানি কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব সায়েদুল ইসলাম। ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি কর্মসূচির উপদেষ্টা মাহমুদ হোসেন, বিএডিসির সদস্য পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ। উদ্বোধনী দিনে ৪ ট্রাক আলু রপ্তানির উদ্দেশে রংপুর ছেড়ে গেছে।
অপরদিকে, পীরগাছা থেকে এবারও গত বছরের তুলনায় বেশি আলু রপ্তানি করা হচ্ছে। গত বছর এ উপজেলা থেকে সাড়ে ৬০০ মেট্রিক টন আলু বিদেশে গেলেও এবার এ টার্গেট বাড়িয়ে করা হয়েছে সাড়ে ৪ হাজার মেট্রিক টন। এ উপজেলার বেশির কৃষকই রপ্তানিযোগ্য আলু উৎপাদন করেছেন। সান্তা, ডায়মন্ড, গ্রানুলা, কুমারিকা, কুম্ভিকাসহ বিভিন্ন জাতের আলু বীজ কৃষকের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে কৃষি বিভাগ। রংপুর বিভাগ থেকে বিদেশে আলু রপ্তানিতে শীর্ষে রয়েছে এ উপজেলা।
পীরগাছা উপজেলার বেলতলা এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, আলুচাষিরা শ্রমিক দিয়ে উন্নতমানের বস্তায় আলু ভর্তি করে ট্রাকে বোঝাই করছেন। জমি থেকে সরাসরি আলু তুলে বিদেশে রপ্তানির সুযোগ পেয়ে খুশি কৃষকরা।
তাদের একজন নূর হোসেন বলেন, গত বছর থেকে আমি রপ্তানিযোগ্য আলু উৎপাদন করছি। বিভিন্ন দেশ আমাদের আলু কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এতে আমরা অন্যান্য কৃষকের তুলনায় বেশি লাভবান হবার সুযোগ পাচ্ছি।
উপজেলা থেকে বাণিজ্যিকভাবে বিদেশে আলু রপ্তানিতে আশার আলো দেখছেন কৃষকেরা। এছাড়া স্থানীয় বাজারেও দাম বেশ ভালো মিলছে। জমি থেকে প্রতি কেজি আলু ১২-১৪ টাকা দরে বিক্রি করছেন চাষিরা, যা গত বছর ৬-৮ টাকা পর্যন্ত ছিল।
পীরগাছার বিরাহীম গ্রামের কৃষক ফজলু মিয়া ও দেউতি এলাকার নজরুল ইসলামসহ আরো বেশ কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, রংপুরের আলু সারা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি হলেও কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পান না। ৪-৫ টাকা কেজিতে বিক্রি করতে হয়। রপ্তানিকারকদের সঙ্গে কৃষকদের সরাসরি চুক্তি হলে আলুর দাম পাবেন কৃষকরা। এছাড়া উত্তম পদ্ধতিতে চাষাবাদ ছড়িয়ে দিতে কৃষকের প্রশিক্ষণ বাড়ানোর পরামর্শ তাদের।
তবে কৃষি বিভাগ বলছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জাতের আলুর চাহিদার কথা মাথায় রেখে অনেক জাতের আলু আবাদে সহায়তা দিচ্ছে সরকারের কৃষি বিভাগ। এবার রংপুর জেলার ৪০০ আলুচাষিকে উন্নত আলু চাষের জন্য প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। সঙ্গে উন্নত জাতের আলু বীজও সরবরাহ করেছেন।
পীরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিকভাবে সাড়ে চার হাজার মেট্রিক টন আলু রপ্তানির অর্ডার পাওয়া গেছে। সৌদি আরব, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যে সাদা আলুর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সেই চাহিদার কথা বিবেচনা করে সান্তা, ডায়মন্ড, কুমারিকা, গ্রানুলা, কুম্বিকা এলুয়েট, এষ্টারিকস, সানসাইনসহ বিভিন্ন জাতের সাদা আলু উৎপাদনের জন্য কৃষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও উন্নত জাতের আলু বীজ সরবরাহ করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে সাদা আলুর ব্যাপক চাহিদা থাকলেও পার্শ্ববর্তী নেপাল, শ্রীলংকা ও ভূটানে আবার লাল আলুর চাহিদা রয়েছে। তাদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে উন্নত জাতের লাল আলুর উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যেগ নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি রাশিয়াও বাংলাদেশ থেকে আলু কেনার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। অচিরেই এ ব্যাপারে চুক্তি হবে। এটা হলে রংপুর থেকেই প্রায় ৫০ হাজার মেট্রিক টন আলু রপ্তানি করা সম্ভব হবে বলে জানান এ কৃষি কর্মকর্তা।
ইতোমধ্যে রংপুর ছাড়াও নীলফামারী, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম থেকে প্রায় ৩০ হাজার মেট্রিক টন আলু রপ্তানি হয়েছে। এছাড়া বিএডিসিও এ বছর আলু রপ্তানির উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আর কিছুদিন পরে আলু উত্তোলন শেষ হলে তারা সরাসরি বিদেশে পাঠাবে। এমনটাই জানিয়েছেন রংপুর বিএডিসি’র উপ-পরিচালক (আলু) আব্দুল হাই।
তিনি আরও জানান, রংপুর, ঠাকুরগাঁও ও জয়পুরহাট জেলা থেকে বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও কৃষকরা বিদেশে গ্রানুলা, বারি-৭, ইউবিটা জাতীয় আলু রপ্তানি করতে শুরু করেছেন। বিএডিসি এবার মলয়েশিয়ায় আলু পাঠাবে। এ লক্ষ্যে অন্যন্য প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। গত বছর বিএডিসি বিদেশে আলু পাঠিয়েছিল। আলুর মান ভালো থাকায় এবারও বিদেশের বাজারে রংপুরের আলুর চাহিদা রয়েছে।
এদিকে রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহকারী কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আকমল হোসেন জানান, এবার রংপুর জেলায় রেকর্ড ৫১ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ করা হয়েছে। যা গতবারের চাষাবাদের তুলনায় এবার প্রায় ২ হাজার হেক্টর বেশি। তবে রংপুরে যে আলু চাষবাদ হয়, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিদেশে এ আলুর চাহিদা নেই। কারণ আমাদের উৎপাদিত আলুর বেশির ভাগ আকারে ছোট। এ কারণে আমরা উন্নত জাতের বীজ সরবারহ এবং কৃষকদের প্রশিক্ষিত করে এবার বিদেশে আলু রপ্তানি শুরু করতে সক্ষম হয়েছি। এখন যেভাবে বিভিন্ন দেশ থেকে আলু কেনার চাহিদা বাড়ছে, তাতে করে এবার রংপুর থেকে আলু রপ্তানির পরিমাণ ৫০ হাজার টনের কাছাকাছি পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
রংপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মোস্তফা সোহরাব চৌধুরী টিটু বলেন, সারা দেশে চাহিদার ২৫ ভাগ আলুর জোগান দেয় রংপুর বিভাগ। তাই রংপুর বিভাগ থেকে আলু রপ্তানির ওপর গুরুত্বারোপ করেছে সরকার। বর্তমানে বিশ্বের অন্তত ১০টি দেশে রংপুরের আলু রপ্তানি হচ্ছে। বিদেশিদের চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে উত্তম পদ্ধতিতে রংপুরে উন্নত আলুর চাষাবাদ করা হচ্ছে। দেশের উদ্বৃত্ত প্রতিটি ফসল বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং কৃষকদের ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা হবে।
সম্প্রতি রংপুরে এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, দেশে পর্যাপ্ত আলু উৎপাদন হচ্ছে। আলুর ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে রপ্তানি বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। রপ্তানি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ বছর ৫১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আলু রপ্তানি থেকে আয় এতে অবদান রাখবে। সরকার আলু উৎপাদন, ব্যবহার ও রপ্তানির বিষয়ে সজাগ রয়েছে।