পুঁজিবাজারের টাকা যাচ্ছে ডলার মার্কেটে!

মূলধন হারানোর ভয়ে পুঁজিবাজার ছাড়ছেন বিনিয়োগকারীরা। বৈশ্বিক অর্থনীতির অস্থিরতায় বাজারে বেশ কিছুদিন ধরে গুজব চলছে। ফলে অনেকে ভয়ে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন।

এর মধ্যে ডলারের বাজার ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার কারণে অনেকে শেয়ার বিক্রির টাকা ডলারে বিনিয়োগ করছেন। ডলার ব্যবসায় নেমেই সপ্তাহের ব্যবধানে সাত থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত লাভও করেছেন কেউ কেউ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশি লাভের আশায় এভাবে হুজুগে পড়ে বিনিয়োগ করলে অনেক সময় হিতে বিপরীত হতে পারে।

ইউসিবি ক্যাপিটালের বিনিয়োগকারী আশিকুর রহমান বলেন, ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো, গ্রামীণফোন ও স্কয়ার ফার্মাসহ ভালো মৌলভিত্তিক ৮ কোম্পানির শেয়ারে আমার ২৭ লাখ টাকা বিনিয়োগ ছিল। গত ১০ দিনের দরপতনে আমার পুঁজি দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ টাকায়। দিন যত যাচ্ছে আমার টাকা তত কমে যাচ্ছে। এখন শুনছি পুঁজিবাজার আরও পড়বে। তাই গত সপ্তাহে ১০ লাখ টাকার শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছি।

তিনি বলেন, ওই টাকার সঙ্গে আরও কিছু যোগ করে ডলার কিনেছি। ডলার প্রতি ৫ টাকা লাভ পেয়েছি। তিন দিনে এক লাখ টাকা লাভ হয়েছে। বাজারের অবস্থা ভালো নয়,যা আছে বিক্রি করে বেরিয়ে যাব।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইবিএল সিকিউরিটিজের এক ট্রেডার বলেন, গত ৫ দিনে কমপক্ষে ২০ জন ক্লায়েন্ট তাদের সব শেয়ার বিক্রি করে পোর্টফোলিও খালি করে ফেলেছেন। তারা এই টাকা ডলার মার্কেটে বিনিয়োগ করবেন বলে শুনেছি।

আইপিডিসি সিকিউরিটিজের সিনিয়র কর্মকর্তা রাসেল সরকার বলেন, কিছুদিন আগে শেয়ার বাজার সংক্রান্ত একটা ফেসবুক গ্রুপের লোকজন আমাকে ডলার ও স্বর্ণ কেনার জন্য বলেছিল। তারা যখন যে ইনফরমেশন দেয় তা সত্যি হয়। যারা কিনেছে এখন তারা লাভ করছে। গোপনে খবর জেনে তারপর বিনিয়োগ করে ওই গ্রুপের লোকজন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারে দরপতন হওয়ার কোনো কারণ নেই। তারপরও ডলার ও জ্বালানি সংকট, মূল্যস্ফীতি এবং বিশ্বমন্দার কারণে দরতপতন হচ্ছে।

তিনি বলেন, ব্যাংকের ফরেইন এক্সচেঞ্জ রেট ভলাটাইল (অস্থির) হয়ে ডলারের দাম বাড়ছে-কমছে। এখন ডলারের রেট একশ’ টাকার ওপরে চলে গেছে। ফলে পুঁজিবাজার থেকে টাকা তুলে লাভের আশায় ডলার মার্কেটে বিনিয়োগ করছেন অনেকে। এই অবস্থা বিরাজ করলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে সব টাকা উঠিয়ে নিয়ে যাবে।

পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পর বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে। তৈরি হয়েছে জ্বালানি সংকট। এ সংকটে অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের টাকার মান কমেছে। বেড়েছে ডলারের দাম। পাশাপাশি হঠাৎ করে দেশে লোডশেডিং বৃদ্ধি ও জ্বালানির মজুত কমে আসছে— এমন খবর প্রকাশ হওয়ায় পুঁজিবাজারে পতন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।

অপরদিকে ডলারের দাম বাড়ছে। ২৪ জুলাই খোলা বাজারে ১০৩ টাকা দরে বিক্রি হওয়া ডলার বৃহস্পতিবার ১১০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ চার দিনে ডলারের দাম বেড়েছে সাত টাকা। আর এক সপ্তাহের ব্যবধানে ডলারের দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১১ টাকা। এ কারণে পুঁজিবাজার ছেড়ে ডলার ব্যবসায় ঝুঁকছেন বিনিয়োগকারীরা।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য মতে, চলতি মাসে পুঁজিবাজারে ১৩ কর্মদিবসের মধ্যে ১১ কর্মদিবসই দরপতন হয়েছে। এই দরপতনে ডিএসইর প্রধান সূচক কমেছে ৩৮৬ পয়েন্ট। সূচকের পাশাপাশি কমেছে লেনদেন হওয়া অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের দাম। আর তাতে বিনিয়োগকারীদের বাজার মূলধন অর্থাৎ পুঁজি সাড়ে ২৬ হাজার কোটি টাকা উধাও হয়েছে। অর্থাৎ দিন যত যাচ্ছে বিনিয়োগকারীরা তত নিঃস্ব হচ্ছেন।

ডিএসইর তথ্য মতে, ঈদের আগে ৭ জুলাই ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৫ লাখ ১৮ হাজার ৭৭২ কোটি ৪৭ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। সেখান থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত ২৬ লাখ ৬৬ হাজার টাকা কমে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৯২ হাজার ১১৩ কোটি ৭ লাখ ৭২ হাজার টাকায়।

ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অফ ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে আস্থার অভাব, অকার্যকারিতা— একই সঙ্গে বাজার অস্থির করে সেখান থেকে কিছু গোষ্ঠীর মুনাফা হাতিয়ে নেওয়ার কারণে অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে ডলারের বাজার।

তিনি বলেন, আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার বর্তমানে অচল। এটাকে সচল করতে হবে। চলমান ডলার বাজারের অস্থিরতায় হয়তো কোনো ব্যাংক বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে। এ জন্য আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে আস্থা বাড়াতে হবে।

এদিকে সংকটের এ সময়ে ডলার নিয়ে কারসাজি করলে সংশ্লিষ্ট মানি এক্সচেঞ্জের লাইসেন্স বাতিল করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ২৮ জুলাই সাংবাদিকদের এ কথা জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম।

ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণ জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০টি টিম মানি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো পরিদর্শন করে। এসময় কিছু অনিয়ম চোখে পড়ে কেন্দ্রীয় ব্যংকের কর্মকর্তাদের।

এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি জসিম উদ্দিন সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, ডলার নিয়ে যারা কারসাজি করেছেন বা করছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা শুনছি অনেকে এখন শেয়ারবাজারের মতো ডলার কেনাবেচা করছে। ডলার কিনে বাজারে সংকট সৃষ্টি করছে। এটি বন্ধ করার দাবি জানিয়েছি আমরা।

আমদানি বেড়ে যাওয়া এবং প্রবাসী আয় কমার কারণে দেশে ডলারের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ফলে দিন দিন বাড়ছে এর দাম। ডলারের বিপরীতে ক্রমাগতভাবে পতন হচ্ছে টাকার মান। ডলার মার্কেট স্বাভাবিক রাখতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে প্রতিদিনই ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

নিউজটি শেয়ার করতে নিচের বাটনগুলোতে চাপ দিন

Facebook
Twitter
WhatsApp
LinkedIn
Print

আপনার মতামত প্রকাশ করুন

এ বিভাগের আরো খবর

ফেসবুক পেজে লাইক দিন

বিভাগীয় সংবাদ