রানির মৃত্যু : শোকের ছায়ার পাশে নির্মম ইতিহাসও

যুক্তরাজ্যের রাজ সিংহাসনে সবচেয়ে দীর্ঘকাল আসীন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুতে শোকের ছায়া পড়েছে বিশ্বজুড়ে, সেই সঙ্গে এ মৃত্যু আরও একবার উস্কে দিয়েছে ব্রিটেনের আড়াইশ’ বছরের উপনিবেশ আমলের নির্মম ইতিহাস।

রানিকে সেই আমলের শেষ প্রভু হিসেবে চিহ্নিত করে ব্রিটেনের রাজপরিবারের চাঁছাছোলা সমালোচনা করছেন দেশটির ঔপনিবেশিক আমলে নির্মম নির্যাতনের শিকার ও বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য হওয়া লোকজনের বংশধররা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের ক্ষোভ ও আক্ষেপপূর্ণ বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া ভাইরালও হয়েছে ইতোমধ্যে।

যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় অঙ্গরাজ্য পেনসিলভেনিয়ার কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাকুইজিশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক উজু আনিয়া রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর এক টুইটবার্তায় বলেন, ‘রানির মৃত্যুতে অবজ্ঞা ছাড়া আর কিছু আমার জানানোর নেই। বাবা এবং মা— উভয় দিক থেকেই আমি সেসব পরিবারের উত্তরাধিকার যারা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে গণহত্যার শিকার হয়েছে এবং বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য হয়েছে। আমার যেসব আত্মীয়-স্বজন এখনও বেঁচে আছেন, তারা সেই ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন। আমি প্রতিদিনই প্রার্থনা করি, তাদের সেই মানসিক যন্ত্রণা যেন দূর হয়।.’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে তার এই টুইট শেয়ার হয়েছে ১০ হাজারেরও বেশি বার এবং প্রায় ৩৮ হাজার টুইটার ব্যবহারকারী তার টুইটে ‘লাইক’ দিয়েছেন।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ৪৬ বছর বয়স্ক আনিয়া জানান, তার মায়ের জন্ম ক্যারিবিয়ান দ্বীপরাষ্ট্র ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোতে এবং বাবার জন্ম নাইজেরিয়ায়। পড়াশোনার সূত্রে তারা নিজ নিজ দেশ থেকে ইংল্যান্ডে এসেছিলেন। সেখানেই তাদের পরিচয় ও বিয়ে হয় তাদের। বিয়ের পর তারা নাইজেরিয়ায় ফিরে যান।

ওইসময় নাইজেরিয়া এবং ত্রিনিদাদ— উভয়ই ব্রিটেনের উপনিবেশ ছিল। উজু আনিয়ার জন্মও হয় সেই ঔপনিবেশিক আমলেই।

নিজেকে ‘উপনিবেশের সন্তান’ হিসেবে উল্লেখ করে আনিয়া বলেন, ‘ব্রিটিশরা একদিকে নাইজেরিয়ায় শাসন-শোষন চালিয়েছে, তেমনি অন্যদিকে ত্রিনিদাদের সাধারণ জনগণকে দাস হিসেবে ব্যবহার করেছে। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে কৃষ্ণাঙ্গদের জোর করে ধরে এনে দাস বানানো ও তাদেরকে ক্যারিবীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে শ্রমদানে বাধ্য করার প্রক্রিয়া গত শতকের পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত জারি রেখেছিল ব্রিটিশরা।’

‘অর্থাৎ আমি এমন লোকজনদের বংশধর, যারা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শোষন ও নির্যাতন সহ্য করার পাশপাশি তাদের দ্বারা দাসত্বেরও শিকার হয়েছে।’

১৯৫২ সালে যুক্তরাজ্যের সিংহাসনে আসীন হন রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। ততদিনে এশিয়া মহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটলেও আফ্রিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দেশ তখনও ব্রিটিশ উপনিবেশের অন্তর্ভূক্ত ছিল।

এশিয়া ও আফ্রিকা অঞ্চলে প্রায় আড়াইশ’ বছর টিকে ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল। এই সময়কালের ইতিহাস বর্ণবাদ, বৈষম্য ও রক্তাক্ত সংঘাতে পরিপূর্ণ। রানি এলিজাবেথ বরাবরই নিজেকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের উত্তরাধীকার বলে মনে করতেন বলে সমালোচনা রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের রোড আইল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের রোড আইল্যান্ড স্কুল অব ডিজাইনের ফটোগ্রাফি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জোয়ে সামুজি। তার আদি বাসস্থান আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলীয় দেশ জিম্বাবুয়ে, যা একসময় ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল। এখনও তার পরিবারের অনেক সদস্য জিম্বাবুয়েতে থাকেন।

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর প্রতিক্রিয়ায় এক টুইটবার্তায় ‍তিনি লেখেন, ‘যদি সুযোগ পাই, তাহলে রাজপরিবারের সব মৃত সদস্যের কবরের ওপর নাচতে চাই আমি। বিশেষ করে তার (দ্বিতীয় এলিজাবেথ) কবরের ওপর।’

জোয়ে সামুজির এই টুইটটিও ভাইরাল হয়ে এবং এ সম্পর্কে আরও তথ্য জানতে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল এনবিসি। কিন্তু তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনে অধ্যাপনা করেন ম্যাথিউ স্মিথ। ক্যারিবীয় অঞ্চলের অন্যতম সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশ জ্যামেইকা থেকে যুক্তরাজ্যে এসে স্থায়ী হয়েছেন তিনি।

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সঙ্গে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সম্পর্ক এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসম্পর্কিত বিভিন্ন ক্ষুব্ধ মতামতের প্রতিক্রিয়ায় এনবিসিকে দেওয়া এক টেলিফোন সাক্ষাৎকারে স্মিথ বলেন, ‘আমি মনে করি, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন নিয়ে মানুষের যে ক্ষুব্ধ মতামত— তা ব্রিটেনের রাজপরিবারের উদ্দেশে, রানির উদ্দেশে নয়। ঔপনিবেশিক শাসনেরস ইতিহাসের সঙ্গে যেহেতু রাজপরিবার অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত, তাই ইতিহাসের বিভিন্ন অন্ধকার অধ্যায়ের দায় এখন রানিকে নিতে হচ্ছে।’

‘যারা ক্ষুব্ধ মতামত জানাচ্ছেন, তাদেরকে অবশষ্য দোষ দেওয়া যায় না। কারণ এশিয়া, আফ্রিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের যেসব দেশে ব্রিটেনের উপনিবেশ ছিল, সেসব দেশে হত্যা, নির্যাতন, দমন-পীড়ন, বর্ণবাদী নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া, জনগণকে জোর করে দাস হিসেবে শ্রম দিকে বাধ্য করাসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যা তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকরা করেনি।’

‘রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ যখন ব্রিটেনের সিংহাসনে আসীন হন, তখন অবশ্য আমল শেষের পথে। তিনি এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্তও ছিলেন না। কিন্তু নির্যাতনের শিকার জনগণের ক্ষোভ গিয়ে পড়েছে তার ওপর।’

তিনি আরও জানান, জ্যামেইকার প্রবীন জনগণ—রানিকে সামনা সামনি দেখার সৌভাগ্য যাদের হয়েছে, তারা তার মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত।

নিউজটি শেয়ার করতে নিচের বাটনগুলোতে চাপ দিন

Facebook
Twitter
WhatsApp
LinkedIn
Print

আপনার মতামত প্রকাশ করুন

এ বিভাগের আরো খবর

ফেসবুক পেজে লাইক দিন

বিভাগীয় সংবাদ