দেশের ৪০ ভাগ চাহিদা পূরণ করছে মানিকগঞ্জের গাজর

গাজর উৎপাদনে খ্যাতি রয়েছে মানিকগঞ্জের। প্রায় ৫০ বছর ধরে জেলার সিংগাইর উপজেলার কৃষকরা এই পুষ্টিকর খাদ্যশস্য উৎপাদন করে আসছেন। শুরুর দিকে চাষাবাদ কম হলেও সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে গাজরের চাষাবাদ। মাত্র তিন মাসের মধ্যে এই অর্থকরী ফসলে অধিক লাভবান হওয়ায় কৃষকরা ধরে রেখেছেন চাষাবাদ।

অনুকূল আবহাওয়া আর উত্তম পরিচর্যায় চলতি মৌসুমের জেলার সিংগাইর উপজেলায় গাজরের ফলন ভালো হয়েছে। এদিকে ফলন ও পাইকারি বাজারে এ বছর গাজরের দাম ভালো থাকায় কৃষক ও ব্যাপারীরা বেশ লাভবান হচ্ছেন।

অন্যদিকে স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে সারা দেশের ৩৫ থেকে ৪০ ভাগ গাজরের চাহিদা পূরণ করছে মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার উৎপাদিত গাজর। ঢাকার কারওয়ান বাজার, শ্যামবাজার, গাজীপুর, যাত্রাবাড়ি, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন পাইকারি মোকামে (বাজারে) এসব গাজর বিক্রি করা হয়।

জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সিংগাইর উপজেলার প্রায় ১০ হাজার কৃষক গাজর চাষাবাদের সঙ্গে যুক্ত। উপজেলার সদর ইউনিয়নের আজিমপুর, চরআজিমপুর, জয়মন্টপ, শায়েস্তা, জামির্ত্তা ইউনিয়নে গাজরের চাষাবাদ বেশি হয়। চলতি মৌসুমে সিংগাইর উপজেলায় কৃষকরা ১ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে কৃষকরা গাজরের আবাদ করেছেন। এ বছর চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১ হাজার ১০০ হেক্টর। গত বছর এক হাজারের কিছু বেশি জমিতে গাজরের আবাদ হয়েছিল আর উৎপাদন হয়েছিল ৪১ মেট্রিক টন গাজর। যা প্রতি হেক্টর জমিতে গাজর উৎপাদন হয়েছিল ৪১ মেট্রিক টন।

চলতি মৌসুমেও গাজরের ফলন ভালো হয়েছে। এ বছর প্রতি হেক্টর জমিতে গাজরের ফলন হয়েছে ৪২ মেট্রিক টন করে। যার গড় হিসাব অনুযায়ী চলতি মৌসুমে গাজরের উৎপাদন হয়েছে ৪২ হাজার মেট্রিক টন। কৃষকরা এক বিঘা জমির গাজর পাইকারি ব্যাপারীদের কাছে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকায় বিক্রি করে থাকেন বলে লাভবান কিছুটা কম হন। তবে কৃষকদের কাছ থেকে পাইকারিভাবে গাজর কিনে ব্যাপারীরা পাইকারি বাজারে বেশি দামে বিক্রি করায় লাভটা বেশি পান বলে জানায় কৃষি অধিদপ্তর।

সরেজমিন সিংগাইর উপজেলার নয়াডাঙ্গী এলাকায় জমি থেকে গাজর তোলার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষক পিয়ার আলী খান (৫৭)। সরেজমিনে আলাপ হলে তিনি বলেন, ৩২ বছর ধরে গাজরের আবাদ করছি। নিজের ১২ বিঘা জমিসহ অন্যের কাছ থেকে কটে রাখা আরও ২০ বিঘা জমিসহ মোট ৩২ বিঘা জমিতে এবার গাজরের আবাদ করেছি। এতে আমার প্রায় ১২ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। তবে ফলন ভালো হলে বিঘাপ্রতি ২০০ থেকে ২২০ মণ গাজর উৎপাদন হবে। এবার স্থানীয় বাজারসহ পাইকারি বাজারে গাজরের দাম ভালো পাওয়ায় মূলধন তোলার পরও বেশ লাভবান হব বলে আশা করছি।

রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বাসিন্দা সেন্টু প্রামাণিক বলেন, প্রতিবছরের তিন মাস মানিকগঞ্জের সিংগাইরে গাজর তোলার কাজ করছি প্রায় ১৫ বছর। প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত গাজর তুলে বস্তায় ভরি। এরপর জমি থেকে এসব গাজরের বস্তা ট্রাকে করে খোলায় (গাজর ধোঁয়ার জায়গা) নিই। সেখান সনাতন পদ্ধতিতে এসব গাজর পানি দিয়ে ধোয়ার পর আবার ট্রাকে তোলা হয়। এই কাজ করে প্রতিদিন আমাগো মজুরি হিসাবে ৭০০ টাকা থেকে ১০০০ হাজার টাকা পাই।

গাজরের সময় তিন মাস কাজ করে প্রায় লাখখানেক টাকা আয় করেন একই এলাকার শ্রমিক আবু বক্কর। তিনি বলেন, তিন মাস কাজ করে প্রায় লাখখানেক টাকা আসে। এ টাকা দিয়া সংসারের বিভিন্ন কাজ করি। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হয় গাজর তোলা, ধোয়ার কাজে। দীর্ঘদিন এই কাজের সঙ্গে যুক্ত আছি। তয় গাজর চাষাবাদে কৃষক তেমন দাম না পেলেও পাইকারি ব্যাপারীরা ভালোই দাম পায়। কৃষকের ফলন ভলো না হলে চালানই (মূলধন) তোলা কষ্টসাধ্য হয়।

কৃষক আক্কাস আলী বলেন, এবার পাঁচ বিঘা জমিতে গাজরের চাষ করেছি। জমিতে হালচাষ, বীজ, সার, কীটনাশক ও শ্রমিকের মজুরি নিয়ে খরচ হয়ে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। গাজর বিক্রি করেছি ২ লাখ ২০ হাজার টাকার। এবার মূলধন তুলনায় কিছুটা লাভ হয়েছে। তবে এক কেজি গাজরের বীজ কিনতে হয়ে ২০ থেকে ২২ হাজার টাকায়। সরকার যদি বীজ, সারের দাম কমাইয়া দিত, তাহলে আমরা চাষাবাদ করে পরিবার নিয়া চলতে পারতাম।

ব্যাপারী নুরুল মিয়া বলেন, প্রায় ১৫ বছর ধরে গাজরের ব্যবসা করছি। আমরা ব্যাপারীরা কৃষকদের কাছ থেকে মুক্তাদরে প্রতি বিঘা গাজর কিনি ৩০ থেকে ৭০ হাজার টাকা করে। ফলন ভালো হলে কৃষকরা ভালো দাম পায় আর ফলন ভালো না হলে কৃষকরা কম দাম পায়। তবে একেবারে যে কৃষকরা গাজর চাষ করে লোকসানে থাকে, বিষয়টা এমন নয়।

পাইকারি ব্যবসায়ী মো. সোবাহান গাজী বলেন, আমাগো সিংগাইরের গাজরে খেতে অনেক সুস্বাদু। যে কারণে রাজধানী ঢাকাসহ দেশে বিভিন্ন অঞ্চলে এর চাহিদা রয়েছে। আমরা কৃষকদের কাছ থেকে গাজর কিনি প্রতি কেজি ১০ থেকে ১২ টাকা দরে। আর পাইকারি বাজারে বিক্রি করি ১৪ থেকে ১৬ টাকা কেজি দরে। এ বছর প্রায় ২০০ বিঘা জমির গাজর কিনেছি। ঢাকার কারওয়ান বাজার, শ্যামবাজার, গাজীপুর, যাত্রাবাড়ি, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন পাইকারি মোকামে (বাজারে) এই গাজর বিক্রি করা হয়।

মানিকগঞ্জ কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের বিপণন কর্মকর্তা মো. ফয়জুল ইসলাম বলেন, এ জেলার উৎপাদিত গাজর খেতে মিষ্টি ও সুস্বাদু। এ জন্য দেশের বিভিন্ন এলাকায় এর চাহিদাও রয়েছে বেশ। যোগযোগব্যবস্থা ভালো থাকায় কৃষকরা ঢাকার বিভিন্ন পাইকারি বাজারে এসব গাজর বিক্রি করতে পারছে। এতে তাদের পরিবহন খরচও কম লাগছে।

তিনি আরও বলেন, গাজর বিক্রির ক্ষেত্রে আমরা ঢাকার কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন পাইকারি বাজারের পাইকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কৃষকদের যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দিই। যাতে কৃষকরা গাজর বিক্রি করে লাভ একটু বেশি করতে পারেন। তবে বেশির ভাগ কৃষক স্থানীয় ব্যাপারীদের কাছে গাজর মুক্তার দামে বিক্রি করে দেন। ফলে কৃষকরা ব্যাপারীদের তুলনায় কিছুটা লাভ কম পান।

নিউজটি শেয়ার করতে নিচের বাটনগুলোতে চাপ দিন

Facebook
Twitter
WhatsApp
LinkedIn
Print

আপনার মতামত প্রকাশ করুন

এ বিভাগের আরো খবর

ফেসবুক পেজে লাইক দিন

বিভাগীয় সংবাদ