চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে গুলে জান্নাত সুমি (৩০) ও জান্নাতুন নাঈম খুশবু (২৭) নামে আপন দুই বোন একসঙ্গে ৪১তম বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। তাদের এই সাফল্যে পরিবারে আনন্দের বন্যা বইছে। বাবা-মায়ের অনুপ্রেরণায় সফল হয়েছেন বলে জানিয়েছেন তারা।
গুলে জান্নাত সুমি শিক্ষা ক্যাডারে আর তার ছোট বোন জান্নাতুন নাঈম খুশবু কৃষি ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। তারা চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার মকিমাবাদ এলাকার মো. এয়াকুব মিয়া ও রুপিয়া বেগম দম্পতির মেয়ে। বাবা এয়াকুব মিয়া বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। মা রুপিয়া বেগম পেশায় একজন গৃহিণী। তিন বোনের মধ্যে সুমি মোজো ও খুশবু সবার ছোট।
জানা গেছে, গুলে জান্নাত সুমি ২০০৭ সালে হাজীগঞ্জ পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ২০০৯ সালে হাজীগঞ্জ সরকারি মডেল কলেজ থেকে এইচএসসি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়ে রাজনীতি বিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন।
অন্যদিকে জান্নাতুন নাঈম খুশবু ২০১১ সালে হাজীগঞ্জ পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি, ২০১৩ সালে হাজীগঞ্জ সরকারি মডেল কলেজ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এইচসএসসি, ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন। তিনি অষ্টম শ্রেণি থেকে স্নাতক পর্যন্ত একাধিকবার বৃত্তি পেয়েছেন।
গুলে জান্নাত সুমি বলেন, পরিবারের ওপর চাপ কমানোর জন্য এবং স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য আমি অনার্স ৪র্থ বর্ষে উঠে চাকরির জন্য চেষ্টা করি। তখন চাকরি সর্ম্পকে ধারণা নিই। ওই সময় আমার স্বপ্ন জাগে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার। মাস্টার্স পরীক্ষা শেষে ঢাকায় চলে আসি। পরে ২০১৮সালে আঞ্জুমান মোখলেছুর রহমান পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে জুনিয়র ইনস্টাক্টর পদে যোগদানের পর ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে ব্যাচেলর অফ এডুকেশন কোর্সে ভর্তি হয়ে শিক্ষা বিষয়ক পড়ালেখা শুরু করি। চাকরি করার পাশাপাশি বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নিই। সহকর্মীরা পড়ালেখা করার জন্য অনেক সহযোগিতা করেছেন।
তিনি আরও বলেন, আমি প্রথমে ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষা দিই। আশানুরূপ ফল না পেয়ে স্বপ্ন পূরণের জন্য পুনরায় নতুন উদ্যোমে প্রস্তুতি শুরু করি। ৪০তম বিসিএসের ফলাফলে এসে দেখলাম নিজের রোল নন-ক্যাডার তালিকায়। নন-ক্যাডারে নিয়োগ পাওয়ার পর চাকরির পাশাপাশি পড়ালেখা করা অনেক কষ্টকর হয়ে পড়ে। তবে হাল ছাড়িনি, যতটুকু সময় পেয়েছি পড়ালেখা করেছি। ৪১তম বিসিএসে পরিপূর্ণতা পাই। এ জন্য সর্ব প্রথম মহান আল্লাহ তায়ালা ও পরিবারের কাছে কৃতজ্ঞ। সবার কাছে দোয়া কামনা করি।
গুলে জান্নাত সুমি বলেন, আমি ভালো একজন শিক্ষক হতে চাই। আমি বিএড, এমএড করেছি। শিক্ষা নিয়ে গবেষণা করতে চাই। শিক্ষাক্ষেত্রে আরও উন্নয়ন ঘটাতে চাই। সরকারের একজন কর্মচারী হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে সর্বদা ন্যায় ও সত্যের পথে থেকে কাজ করতে চাই।
জান্নাতুন নাঈম খুশবু বলেন, আমি ক্যাম্পাসে থাকা অবস্থায় বিসিএসের জন্য পড়ালেখা করি । যখন দেখতাম সিনিয়ররা বিসিএস দিয়ে ক্যাডার হয়েছে, একজন আরেকজনকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে, আমারও খুব ইচ্ছা করতো। আমি স্বপ্ন দেখতাম একদিন আমিও বিসিএস জয় করবো। ক্যাম্পাসের সিনিয়রদের উৎসাহে আজ আমি সাফল্য অর্জন করেছি। শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৯ সালে স্নাতক ও ২০২০ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করি। স্নাতকোত্তরের ফল এখনো অপ্রকাশিত। যখন ৪১তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয় তখন আমি সদ্য গ্র্যাজুয়েট। তখনও চাকরির তেমন প্রস্তুতি শুরু করিনি। অনেকটা আনাড়ি মনোভাব নিয়েই প্রথমবারের মতো বিসিএসে অ্যাপ্লাই করে ফেলি। ২০২০ সালে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হবার কথা থাকলেও করোনা মহামারির জন্য তা পিছিয়ে যায়। আর আমিও প্রস্তুতির জন্য কিছু সুযোগ পেয়ে যাই। তখন থেকে শুরু হয় আমার বিসিএস প্রস্তুতি। যেহেতু প্রিলিমিনারি হয়েছিলো ২০২১ সালের ১৯ মার্চ, আমি এক বছরেরও বেশি সময় পাই। এ জন্য ভালোভাবেই প্রস্তুতি সম্পন্ন করি এবং আল্লাহর রহমতে প্রিলি-রিটেন পাস করি। এরই মধ্যে ২০২২ সালের ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোতে যোগদান করি এবং বর্তমানে কর্মরত আছি।
তিনি বলেন, যখন ৪১তম বিসিএসের ফলাফল প্রকাশিত হয়, তখন তালিকায় স্থান পেয়ে সত্যিই আপ্লুত হয়েছি। ২০১৯ থেকে ২০২৩ এই দীর্ঘ সময়ের জার্নিতে পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং সহকর্মীদের থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা পেয়েছি। সর্বোপরি মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য সর্বদা প্রার্থনা করেছি এবং সৃষ্টিকর্তা আমার প্রতি সদয় হয়েছেন বলেই আমি ৪১তম বিসিএসে কৃষি ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি।
জান্নাতুন নাঈম খুশবু বলেন, বাংলাদেশে কৃষিতে একটি সম্ভাবনা রয়েছে। আমার কৃষি নিয়ে কাজ, গবেষনা করার স্বপ্ন আছে। কৃষিকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিতে চাই। আমি সরকারের একজন কর্মচারী হিসেবে সর্বদা দেশ ও জাতির সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখবো।
সুমি ও খুশবু বলেন, বাবা-মায়ের অনুপ্রেরণায় আমরা সফল হয়েছি। আমাদের কোনো ভাই নেই। বাবা-মা বলতেন, ‘আমাদের কোনো ছেলে নেই, তোমাদেরকেই আমাদের সম্মান রাখতে হবে। তোমাদের এমনভাবে তৈরি হতে হবে। নিজেদের স্বাবলম্বী করতে হবে।’ পাশাপাশি বড় বোন ও দুলাভাই উৎসাহ দিয়েছেন। তাছাড়া কলেজের শিক্ষক, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনরা উৎসাহ দিয়েছেন। তাদের দোয়ায় আমরা আজ এই জায়গায় পৌঁছেছি।
বাবা এয়াকুব মিয়া ও মা রুপিয়া বেগম বলেন, আমরা আজ অনেক আনন্দিত। তারা আমাদের স্বপ্ন পূরণ করেছে। তারা দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করবে।