বছরের এই মৌসুমটায় সারি সারি চা-বাগানে থাকার কথা শ্রমিকদের কর্মচঞ্চলতা। কিন্তু বিপরীতে সুনসান নীরবতা। সারা দেশের ১৬৭টি চা-বাগানের এখন এই দশা। প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে চা উৎপাদনের একমাত্র উপাদান কচি কচি দুটি পাতা ও একটি কুঁড়ি।
জানা যায়, ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে চা-শ্রমিকদের মজুরি বাড়িয়ে ১২০ টাকা বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। তবে এই মজুরিতে তারা সন্তুষ্ট ছিলেন না। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে বিভিন্নভাবে দাবি জানিয়ে আসছেন শ্রমিকরা, যাতে মজুরি ন্যূনতম ৩০০ টাকা করা হয়। বিষয়টি নিয়ে মালিকপক্ষের সঙ্গে সরকার ও শ্রমিক সংগঠনের একাধিক সভাও হয়েছে।
সর্বশেষ আরও ১৪ টাকা মজুরি বৃদ্ধির জন্য মালিকপক্ষের কাছ থেকে গ্রিন সিগন্যাল পান শ্রমিকরা। কিন্তু দেড় বছর ধরে সেটিও বাস্তবায়ন করছে না মালিকপক্ষ। সেই না পাওয়ার হতাশা আজ বিস্ফোরিত হয়ে কর্মবিরতি আন্দোলনে রূপ নিয়েছে।
শমশেরনগর চা-বাগানের ফাঁড়ি দেওছড়া নারী শ্রমিক লক্ষ্মী রবিদাস বলেন, পত্রের দাম হু হু করে বাড়ে, কিন্তু আমাদের মজুরি বাড়ে না। সারা দিন রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে সেকশনে সাপ, বিছা, পোকামাকড়ের মধ্যেও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজ করি। সপ্তাহে যে তলব (সপ্তাহের মজুরি) পাই তা দিয়ে সংসার চালানোই কঠিন। আমরা আর বছর বছর মজুরি বাড়ানোর জন্য আন্দোলন করতে চাই না। এবার হয় মজুরি বাড়বে, নয়তো আর বাগানে কাজ করব না।
সুশাসনের জন্য নাগরিক মৌলভীবাজারের সাধারণ সম্পাদক জহর লাল দত্ত ঢাকা পোস্টকে বলেন, চা-শিল্পের মূল কারিগর চা-শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির চুক্তি হওয়ার কথা প্রতি দুই বছর অন্তর। কিন্তু সেটি আর করা হয় না। বর্তমানে একজন মানুষের দৈনিক ব্যয় প্রয়োজন ২৬০ টাকা। সেখানে চা-শ্রমিকরা সর্বোচ্চ পান মাত্র ১২০ টাকা, যা অমানবিক। চা-শ্রমিকদের এই সংকট সমাধানে সরকারকে এগিয়ে আসা উচিত। তাদের এই যৌক্তিক দাবি যে অনতিবলম্বে মানা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ চা সংসদ ও চা শ্রমিক ইউনিয়নের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী চা-শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১০২ টাকা থেকে ১৮ টাকা বাড়িয়ে সর্বোচ্চ মজুরি ১২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী চা শ্রমিকদের মজুরি এ-ক্লাস বাগানে ১২০ টাকা, বি-ক্লাস বাগানে ১১৮ টাকা ও সি-ক্লাস বাগানে ১১৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এর আগে ২০১৫ সালের ৬ অক্টোবর চা-শ্রমিকদের মজুরি চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে ৬৯ টাকা থেকে বেড়ে ৮৫ টাকায় উন্নীত হয়। সম্পাদিত ওই চুক্তি মোতাবেক ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর করা হয়।
২০১৮ সালের ২০ আগস্ট স্বাক্ষরিত পরবর্তী দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৮৫ টাকা থেকে ১৭ টাকা বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ১০২ টাকা মজুরি নির্ধারণ করা হয়। ওই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় আগের চুক্তি স্বাক্ষরেরও দীর্ঘ ২০ মাস পার হওয়ার পর। সেই চুক্তির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয় ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে।
২০২০ সালের ১৫ অক্টোবরে হওয়া সর্বশেষ চুক্তির মেয়াদ ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কার্যকর ছিল। স্বাক্ষরিত সর্বশেষ চুক্তি বাস্তবায়ন হয়। বর্তমানে মজুরি চুক্তির মেয়াদ ১৯ মাস উত্তীর্ণ হওয়ার পথে। এরপর মজুরি বৃদ্ধির নতুন চুক্তি আর হয়নি।
নতুন করে মজুরি চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় চা-শ্রমিকরা সর্বোচ্চ ১২০ টাকা মজুরিতেই চলছেন। করোনা মহামারির ঝুঁকি নিয়ে জীবন-জীবিকার তাগিদে আগের মজুরিতেও তারা নিয়মিত কাজ করেছেন। তবে এত অল্প মজুরিতে দুঃখ-কষ্টে পাঁচ, সাত সদস্যের শ্রমিক পরিবারের সংসার চালাতে হচ্ছে।
শমশেরনগর কানিহাটি চা-বাগানের নারী শ্রমিক আলোমনি মৃধা ও মিনা রায় বলেন, হামরা চা-শ্রমিকরা ১২০ টাকা মজুরি পাইয়া কীভাবে সংসার চালাব? বাজারে জিনিসপত্রের যে দাম বাড়ছে, তাতে এই টাকা দিয়া সংসার চলি না। এক একটা ঘরে বাচ্চা-কাচ্ছা লইয়া পাঁচজন, সাতজন থাকি। তারার খরচ কেমনে চলবি?
চা-শ্রমিক নেতা সিতারাম বীন বলেন, করোনাকালীন ঝুঁকি নিয়েও আমরা সারাক্ষণ চা-বাগানে কাজ করেছি। প্রতিটি বাগানে স্বাস্থ্যসুরক্ষা ছাড়াই দলবদ্ধভাবে কাজ করেছি। এসব ঝুঁকি নিয়ে কাজ করলেও মজুরি বৃদ্ধির চুক্তির মেয়াদ ১৯ মাস অতিবাহিত হয়েছে। চা-বাগানে আমাদের এই মজুরি পাওয়ার পর সপ্তাহে হয় কারেন্ট বিল, অনুষ্ঠান চাঁদা, ইউনিয়ন চাঁদা এসব কর্তনের পর সাড়ে চার থেকে সাড়ে পাঁচ শ টাকা থাকে। এই টাকায় এক বেলাই খাবার চালানো দায়।
বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিপেন পাল বলেন, পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট চলছে। দেশের ১৬৭টি চা-বাগানে এই ধর্মঘট পালিত হচ্ছে। ৩০০ টাকা মজুরি না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। না মানা হলে আন্দোলন কঠোর থেকে কঠোরতর হবে। এবার দেশের বিভিন্ন বাগানের চা-শ্রমিকরা একত্র হয়েছেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশি চা-সংসদের সিলেট বিভাগের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ শিবলী বলেন, মালিকপক্ষের সঙ্গে শ্রমিকদের আলোচনা চলাকালে এভাবে কাজ বন্ধ করে আন্দোলন করা বেআইনি। এখন চা-বাগানে ভরা মৌসুম। কাজ বন্ধ রাখলে সবার ক্ষতি। তারাও এই মৌসুমে কাজ করে বাড়তি টাকা পায়। ‘আমরা সরকারকে অনুরোধ করেছি যাতে তাদের কাজে ফেরানোর ব্যবস্থা করা হয়।
আরু পড়ুন : অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতিতে চা শ্রমিকরা
শ্রম অধিদপ্তর শ্রীমঙ্গলের উপপরিচালক মো. নাহিদুল ইসলাম বলেন, শ্রীমঙ্গল ও ঢাকায় চা শ্রমিকদের নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায় ও মালিকপক্ষ বসেছেন। আলোচনায় থাকা অবস্থায় তারা আন্দোলনে গেছেন। মালিক ও শ্রমিকপক্ষ আলোচনায় আছে। অফিসিয়ালি আলোচনা থেকে কেউ বেরিয়ে যায়নি। আলোচনায় থাকা অবস্থায় ধর্মঘট শ্রম আইনের পরিপন্থী। চা-শ্রমিক ইউনিয়ন দাবিনামা উত্থাপন করেছে।
চা শ্রমিক ইউনিয়ন সূত্রে জানা যায়, ঢাকায় শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, বাংলাদেশ চা সংসদ ও বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ত্রিপক্ষীয় সভায় মালিক পক্ষ আমাদের ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৪০ টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। এরপর সারা দেশের ৭টি ভ্যালিতে ৭টি আলাদা আলোচনা সভা হয়। কোনো সভায় এই প্রস্তাবের সম্মতি আসেনি। এরপর মালিকপক্ষের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান হয়ে যায়। আবারো চলমান থাকবে ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি কর্মসূচি।
উল্লেখ্য, আগামী ২৩ আগস্ট ঢাকায় আরেকটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের কথা রয়েছে। ১০ আগস্ট থেকে চার দিন দুই ঘণ্টা করে কর্মবিরতি করে, পরবর্তীতে গত ১৩ আগস্ট শনিবার থেকে সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য শ্রমিক ধর্মঘট পালন করার ডাক দেয় বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন। এখন পর্যন্ত তারা এই আন্দোলনে অনড় আছে।