বন্যার পানিতে ঘরবাড়ি ভেসে যাওয়ায় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছেন ইব্রাহিম মিয়া ও তার পরিবার। এর মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রে শুরু হয়েছে শোকের মাতম। দীর্ঘদিন রোগে ভোগা ইব্রাহিমের বাবা আশরাফ আলী (৮৫) মারা গেছেন।
নৌকা না থাকায় বাবাকে নিতে পারেননি হাসপাতালে। একদিকে ঘরবাড়ি নেই, চারপাশে থইথই করছে পানি, অন্যদিকে বাবাকে হারিয়ে কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না রিকশাচালক ইব্রাহিম। তাই বাবার মরদেহ পলিথিনে মুড়ে বক্সের ভেতর রেখে কবরস্থানের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রেখেছেন পাঁচ দিন ধরে। পানি নামলে মাটিতে শুইয়ে রাখবেন, এই আশায় আছেন তিনি।
বন্যার সময় সাধারণত কোনোভাবে মরদেহ দাফন করতে না পারলে পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু নিজের বাবার মরদেহ বন্যার পানিতে ভাসিয়ে দেওয়ার সাহস হয়নি ইব্রাহিমের। তাই পলিথিনে মুড়ে বাক্সবন্দি করতে হয়েছে তাকে।
এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে সুনামগঞ্জ শহরতলির সুরমা ইউনিয়নের ইব্রাহিমপুর গ্রামে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা ইব্রাহিম জানান, গত ১৭ জুন (শুক্রবার) দিবাগত রাত সাড়ে ১২টায় তার বাবা মারা যান। সর্বত্র বন্যার পানি থাকায় বাবার মরদেহ দাফন করতে না পারায় তিনি বাক্সবন্দি করে রেখেছেন।
ইব্রাহিম বলেন, ‘আব্বা মারা গেছইন। আমরার কবরস্থান পানির নিচে। জানাজাও পড়ছি নৌকার ওপর। আমরা অসহায় হয়ে গেছি। এখন বসে আছি কখন পানি কমবে আর লাশ দাফন করতে পারব।’
একই গ্রামে একই দিন মৃত্যু হয় সাজু মিয়া নামে একজনের। তিনি ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ আসার পথে মারা যান। ছাতকের গোবিন্দগঞ্জ এলাকায় বন্যার কারণে আটকে যায় তাদের গাড়ি। সেখানেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি।
মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় এক অটোরিকশা চালকের মাধ্যমে বাড়িতে খবর পাঠানো হয়। পরে সাজু মিয়ার মেয়েজামাই ছালাতুল নৌকাযোগে শ্বশুরের লাশ গ্রামে নিয়ে আসেন।
এখন পাশাপাশি বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে আছেন সাজু মিয়া ও আশরাফ আলী। মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত আশরাফ আলীর বাক্সের নিচে কিছুটা মাটি দেখা গেলেও পানির ওপরে ভাসছে সাজু মিয়ার বাক্সবন্দি মরদেহ।
সাজু মিয়ার জামাতা সালাতুল ইসলাম বলেন, দুদিন ধরে আমার শ্বশুর আর ছেলের খোঁজ পাচ্ছিলাম না। পরে একজন এসে খবর দেন শ্বশুর আব্বা মারা গেছেন। অনেক কষ্টে একটা নৌকা জোগাড় করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছুটে যাই গোবিন্দগঞ্জ। সেখান থেকে লাশ এনে এখন বাক্সের ভেতর ভরে রেখেছি। পানি কমলে মাটি দেব।
এলাকাবাসী জানান, ছয় দিন ধরে পুরো জেলা ডুবে আছে পানির নিচে। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, বাজার এমনকি উঁচু কবরস্থানও পানির নিচে ডুবে আছে। পা রাখার এতটুকু জায়গা নেই কোথাও। মানুষের বাড়িঘরে গলা পর্যন্ত পানি। এই পরিস্থিতিতে আরও বিপদ হয় কেউ মারা গেলে। কারণ, মরদেহ দাফনের কোনো উপায় থাকে না।
তারা জানান, বন্যার সময় কবরস্থান পানির নিচে ডুবে যাওয়ায় মরদেহ দাফন করা যায় না। তাই হাওর এলাকার কবরগুলো উঁচু করার উদ্যাগ নেওয়া খুব প্রয়োজন। অন্তত কবরগুলো যদি উঁচুতে থাকে, তাহলে শেষ সময়ে এক মুঠো মাটি পড়বে লাশের ওপর।
গ্রাম পুলিশ আসকর আলী বলেন, এমন ভয়াবহ বন্যা আমরা কেউ জীবনে দেখিনি। বন্যার কারণে লাশ নিয়ে বসে আছি পাঁচ দিন ধরে। বাক্সের ভেতর ভরে রেখেছি। এখনো আছে।
মৃত আশরাফ আলীর মেয়ে রেজিয়া বেগম বলেন, ঘরে পানি ওঠায় স্কুলে আসছিলাম। স্কুলে এসে আব্বা মারা যান। কোনো উপায় না পেয়ে এখন এক বোনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি।