ঈশ্বরদীতে লিচুর বাম্পার ফলন, বেচাকেনার ধুম

পাবনার ঈশ্বরদী বর্তমানে লিচুর দ্বিতীয় বৃহত্তর রাজধানী হিসেবে পরিচিত। দেশব্যাপী এখানকার রসালো মিষ্টি লিচুর বেশ কদর রয়েছে। এ বছর উপজেলাটিতে লিচুর বাম্পার ফলন হয়েছে। তবে দাম নিয়ে চাষিদের রয়েছে মিশ্রপ্রতিক্রিয়া। কেউ কেউ বাজারদরকে স্বাভাবিক বললেও অনেকেই হতাশার কথা জানিয়েছেন।

ঈশ্বরদীর লিচুর হাটগুলোতে এরই মধ্যে বেচাকেনা বেশ জমে উঠেছে। জেলার সবচেয়ে বড় লিচুর হাট আওতাপাড়ায় ভোরের আলো ফোটার আগেই হাটে বেচাকেনা শুরু হয়ে চলে সকাল ৮টা পর্যন্ত। আঁটি জাতের লিচু আসলেও বোম্বাই লিচু বাজারে আসতে আরও কয়েকদিন সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন চাষিরা।

রোববার (১৫ মে) সকালে ঈশ্বরদীর শিমুলতলা, আওতাপাড়া ও ছলিমপুর হাটে গিয়ে দেখা যায়, আঁটি জাতের লিচু প্রকারভেদে ১২০০-১৮০০ টাকা পর্যন্ত কৃষকদের কাছ থেকে ক্রয় করছেন আড়তদাররা। পরে আড়তদারের কাছ থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা ক্রয় করছেন।

ঈশ্বরদীজুড়ে বিদেশি হাইব্রিড বা বোম্বাই লিচু ও দেশীয় আঁটি জাতের লিচুর বাগান করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীরা দেশি প্রজাতির আঁটির লিচু ভাঙতে শুরু করেছেন। বোম্বাই লিচু ভাঙতে এখনো কয়েকদিন সময় লাগবে। বাজারের আনাচে-কানাচে সব জায়গাতেই লিচু শোভা পাচ্ছে।

ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সূত্রে জানা যায়, জেলার ঈশ্বরদী পৌরসভা ও সাতটি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে ৩ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে লিচুর গাছ রয়েছে মোট ২ লাখ ৮৩ হাজার ৫০০টি। বিঘা প্রতি ২০ থেকে ১৫টি গাছ অর্থাৎ ১ একর জমিতে ৪২টি এবং ১ হেক্টর জমিতে ৯০টি গাছ রয়েছে। লিচুচাষির সংখ্যা ৯ হাজার ৬২০ জন। বাণিজ্যিক আকারে বাগান ২ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে। বিচ্ছিন্নভাবে বসতবাড়িতে আবাদ রয়েছে ৫৫০ হেক্টর। ফলন্ত আবাদি জমির পরিমাণ ২ হাজার ৮৩৫ হেক্টর জমি।

জানা যায়, ঈশ্বরদী উপজেলার ছলিমপুর, মানিকনগর, জয়নগর, মিরকামারি, আওতাপাড়া, বাঁশেরবাদা, সদর উপজেলার চকউগ্রগড়, জোয়ারদহ, হামিদপুর, জয়কৃষ্ণপুর, উগ্রগড়, মৌগ্রাম, আটঘরিয়া উপজেলার গোপালপুর, ত্রিমোহন, পরাণপুর, হিদাশকোল, চাচকিয়া, ষাটগাছা, ডেঙ্গারগ্রামসহ বিভিন্ন গ্রামে ঢুকলেই চোখে পড়বে সারি সারি লিচুর বাগান। সারাদেশের লিচুর চাহিদার একটি বড় যোগান আসে এসব গ্রামের লিচু থেকে। প্রতিবছর ৬ থেকে ৭শ কোটি টাকার লিচু বিক্রি হয় এই জেলা থেকে।

এদিকে ঈশ্বরদী আবহাওয়া অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবার লিচুর ভরা মৌসুমে প্রায় প্রতিদিন সকাল ১০টা বাজতে না বাজতেই ঈশ্বরদীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৪ ডিগ্রি অতিক্রম করে দুপুর নাগাদ ৩৬ থেকে ৩৮-৪০ ডিগ্রির মধ্যে ওঠা-নামা করেছে। এই আবহাওয়া লিচুর জন্য প্রতিকূল ছিল। ফলে গাছে প্রচুর লিচু আসলেও আকারে ছোট হয়েছে।

ঈশ্বরদীর চরমিরকামারী লিচুচাষি ঈসমাইল হোসাইন সরদার জানান, তার ১২ বিঘার ওপরে একটি লিচু বাগান আছে। প্রতি বছর ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার লিচু বিক্রি করেন তিনি। এ বছর ফলন ভালো হয়েছে। আঁটি জাতের লিচুর দাম আশানুরুপ কম হলেও বোম্বাই লিচুতে অধিক দাম পাওয়ার আশা ব্যক্ত করেন তিনি।

ঈশ্বরদীর জয়নগর হাটে কথা হয় আওতাপাড়ার লিচুচাষি বাদশা মোল্লার সাথে। তিনি বলেন, ৩০ বিঘা জমির ওপর ৭৮টি লিচু গাছ রয়েছে। ১০ বিঘা জমিতে আঁটি জাতের লিচু রয়েছে। বাকি বাগানগুলোতে বোম্বাই লিচু চাষ হয়েছে। আঁটি জাতের লিচুর মধ্যে ৬ বিঘা লিচু বাজারে এনে বিক্রি করে দিয়েছি। দাম কম হলেও ফলন ভালো হওয়াতে খরচ যোগাতে তেমন সমস্যা হবে না।

আওতাপাড়া হাটে কথা হয় বরিশাল থেকে আসা বোরহান উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রতি বছর আমি এখানে এসে লিচু কিনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠিয়ে থাকি। আমার এসব লিচু খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা অঞ্চলে পাঠানো হয়। এবার বাগানে ফলন ভালো হওয়ায় বাজারে প্রচুর লিচু আসছে। দামও মোটামুটি নাগালের মধ্যেই আছে।

এদিকে লিচু ভাঙতে প্রচুর শ্রমিকের চাহিদা রয়েছে। এতে অনেক বেকার যুবক ও শিক্ষার্থীদের আয়ের পথ তৈরি হয়েছে। স্কুল ছুটি নিয়ে লিচু বাগানে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করছেন তারা। বাড়ির অনেক বয়স্ক ও মধ্য বয়সী নারীদেরও লিচুর পাতা ছেঁড়ার কাজ করতে দেখা গেছে।

আসমা খাতুন নামে এক নারী বলেন, এ সময় বাড়িতে তেমন কাজ নেই, তাই লিচু বাগানে আঁটি বাঁধা ও পাতা ছেঁড়ার কাজ করছি। সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত কাজ করে ৩শ থেকে সাড়ে ৩শ টাকা পাই।

ঈশ্বরদীর বাঁশেরবাদা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী সোহান বলেন, এখন আমার স্কুল ছুটি রয়েছে। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো না, তাই ছুটিতে লিচুর বাগানে কাজ করছি। প্রতিদিন ৫শ টাকা করে হাজিরা পাই। এতে পড়ালেখার কিছু খরচ জোগাড় হয়।

পাবনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারী কর্মকর্তা কৃষিবিদ মিজানুর রহমান বলেন, এবার পাবনায় ৪ হাজার ৭৩১ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে। এতে ৪০ হাজার ২৩২ মেট্রিক টন লিচুর ফলনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। কিন্তু ফলন ভালো হওয়ায় সেই লক্ষ্যমাত্রা ছাড়েয়ে যাবে।

তিনি আরও বলেন, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর লিচুর রাজধানী খ্যাত পাবনার ঈশ্বরদী। এ অঞ্চলের অন্যতম প্রধান অর্থকারী ফসল লিচু, এটা চাষ করেই অধিকাংশ মানুষের সারাবছর সংসার চলে। গত বছরে ফলন ভালো না হওয়ায় চাষিরা খুব একটা লাভবান হতে পারেননি। তবে এবার ফলন ভালো হওয়ায় চাষিরা বেশ লাভবান হবেন।

নিউজটি শেয়ার করতে নিচের বাটনগুলোতে চাপ দিন

Facebook
Twitter
WhatsApp
LinkedIn
Print

আপনার মতামত প্রকাশ করুন

এ বিভাগের আরো খবর

ফেসবুক পেজে লাইক দিন

বিভাগীয় সংবাদ