ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলার রাঙাটুঙ্গী ইউনাইটেড মহিলা ফুটবল একাডেমির খেলোয়াড় কাকলী আক্তার দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। তিন মাস উন্নত ফুটবল প্রশিক্ষণের জন্য পর্তুগাল যাচ্ছেন কাকলী। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রাঙাটুঙ্গি ইউনাইটেড মহিলা ফুটবল একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক তাজুল ইসলাম।
রাণীশংকৈল উপজেলার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আবুল কাশেম ও বানেসার মেয়ে কাকলী আক্তার (১৬)। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট কাকলী। নিজস্ব বসতভিটা ছাড়া আবাদি কোনো জমি নেই কাকলীদের। ঋণের টাকায় একটি ভ্যান কেনেন তার বাবা। সেই ভ্যান চালিয়ে যা আয় হয়, তা দিয়েই চলে ভরণপোষণ। সামান্য আয় দিয়ে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব ছিলনা বলে অভাব অনটন লেগেই থাকতো সংসারে। কষ্ট করে সংসার চালিয়ে নিতেন কাকলীর মা বানেসা। দিন আনে দিন খায়, এমন পরিবারে অভাবের সাথে অশান্তি যোগ হয় যখন কাকলীর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে বসেন। সে মুহূর্তে আকাশ ভেঙ্গে পড়ে পরিবারটির ওপর। অভাবের সাথে অশান্তি যোগ হয়ে পরিবারের পরিবেশ বিষময় হয়ে ওঠে কাকলীর কাছে। এ অবস্থায় সংসারের হাল ধরতে এগিয়ে আসেন কাকলীর মা বানেসা বেগম। তিনি নিজের কাছে জমানো কিছু টাকা দিয়ে শুরু করেন চা বিক্রি। রাস্তার ধারে ছোট একটি দোকানে চা বিক্রি করেই পরিবার ও কাকলীর খরচের জোগান দিয়েছেন তিনি।
কয়েক বছর পর কাকলীর বাবা নিজ ভুল বুঝতে পেরে দ্বিতীয় সংসার ছেড়ে আবার ফিরে আসেন তাদের কাছে। পরে সব মেনে নিয়ে নতুন করে আবার সংসার চলা শুরু হয় তাদের। বর্তমানে অসুস্থ বয়োবৃদ্ধ বাবা চালান ভ্যান আর মা করছেন চা বিক্রি। তবে মেয়ের ভিনদেশে যাওয়ার কথা যেন সব কষ্ট ভুলিয়ে রেখেছে তাদের।
কাকলীর মা বানেসা বলেন, ‘মোর বেটি ফুটবল খেলে। তাতে নানান জনে নানা ধরনের খারাপ কথা কহে। খারাপ লাগিলে কান্নাকাটি করেছে ফের খেলিবা যাছে’। তিনি আরো বলেন “হামার থাকিবার জায়গা ছাড়া আর কিছু নাই। স্বামী ভ্যান চালায় আর মুই চা বিক্রি করু। এখন হামার বেটি বিদেশত যাছে, এইডা খুবে ভালো লাগেছে। সবাই মোর বেটির তানে দোয়া করিবেন”।
কাকলীর বাবা আবুল কাশেম বলেন, ‘আমি দিনমজুরি করে সংসার চালাতাম। পরে একটা ভ্যান চালানো শুরু করি। এখনো ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাই। আর কাকলীর মা চা বিক্রি করে। আমি বয়সের কারণে নানা রোগে ভুগছি। পায়ের সমস্যা লেগেই আছে। মেয়েটা বিদেশে যাচ্ছে প্রশিক্ষণে, এটি আমার কাছে অনেক আনন্দের। যেখানে যাই সেখানকার লোকজন খোঁজখবর নেয়। চা খাওয়ায় আর কাকলীর গল্প করে। তখন বুকটা আনন্দে ভরে উঠে। আমার মেয়ের জন্য সকলে দোয়া রাখবেন।’
কাকলী আক্তার বলেন, ‘স্কুল পর্যায়ে যে বঙ্গমাতা ফুটবল খেলাগুলো হতো, সেখান থেকেই আমার শুরু। পরে আমার এক স্যার বললেন, আমি ফুটবলার হবো কি না। আমি বলেছিলাম, যদি ভালো সুযোগ পাওয়া যায় তাহলে হব। পরে তিনি আমাকে রাঙাটুঙ্গিতে যোগাযোগ করিয়ে দেন। আমি বাবা-মাকে বিষয়টি বলি। তারা আমাকে সহযোগিতা করেছেন এবং ফুটবল কিনে দিয়েছেন। এখন দেশের বাইরে যাচ্ছি আরও উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য। এটি আসলে অনেক বড় আনন্দের খবর আমার কাছে। তবে এ আনন্দের পেছনে অনেক পরিশ্রম রয়েছে।
মেয়ে মানুষের কিসের ফুটবল খেলা। তাও আবার ছোট প্যান্ট আর গেন্জি পরিয়া। লাজ লজ্জা সব উঠে গেল। এইরকম নানা জনের নানা কটু কথা প্রতিনিয়ত শুনার লাগতো।’ সঙ্গে আড় চোখে মানুষের তাকানো, আড়ালের কটু কথা। ‘কেউ কেউ আবার মুখের সামনেই-কি দরকার মেয়ে হয়ে ফুটবল খেলার’ -এভাবে বলে বিব্রত অবস্থায় ফেলে দিত। মানুষের যেন নিত্য দিনের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল এটি। তবে থেমে থাকেনি আমি। মানুষের কটু কথা থামাতে পারেনি আমার সফলতার পথচলা। মেয়ে হিসেবে ফুটবল খেলতে এসে নানা ধরনের কটু কথা শুনতে হয়েছে।’
কিছুদিন আগেও যারা কটু কথা বলতো এখন তাদের কথার ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। যারা বলেছিল তারাই এখন নিজের সন্তানদের মেয়ে ফুটবলার বানানোর স্বপ্ন দেখছেন। একসময় যারা অপমান করতো তারা এখন আসেন পরামর্শ নেওয়ার জন্য। কিভাবে আমার মত তাদের মেয়েও ফুটবলার হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে রাঙাটুঙ্গি ইউনাইটেড মহিলা ফুটবল একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক তাজুল ইসলাম বলেন, ‘অনূর্ধ্ব-১৭ জাতীয় চ্যাম্পিয়ন দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ১১ জন ছেলে ব্রাজিলে ও ১১ জন মেয়ে পর্তুগালে ফুটবল প্রশিক্ষণের জন্য যাচ্ছে। সেরা এগারোর মধ্যে আমাদের ঠাকুরগাঁও জেলা থেকে একজন নির্বাচিত হয়েছেন। সে রাণীশংকৈল
রাঙাটুঙ্গি ইউনাইটেড মহিলা ফুটবল একাডেমির খেলোয়াড়। কাকলী নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে। তার বাবা বৃদ্ধ মানুষ, ভ্যান চালান। কিন্তু এ বয়সে ঠিকমতো চালাতে পারেন না। ভ্যানই একমাত্র আয়ের উৎস তাদের। আর তার মা চা বিক্রি করেন।
একজন কাকলী, যে একটি হতদরিদ্র পরিবারে সংঘাতময় পরিবেশে বেড়ে উঠেও নিজ লক্ষ্যে অবিচল থেকেছেন। তার দৃঢ় মনোবোল, ধৈর্য, কঠোর পরিশ্রম, আর আত্মবিশ্বাস অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে সহায়তা করেছে। কাকলী প্রান্তিক মানুষের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে আগামী দিনগুলোতে।
এমন খুশির খবর শুনে রাণীশংকৈল পৌরসভার মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক বলেন, ‘আমার পৌরসভার এক হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান কাকলী। তার মা চা বিক্রি করে তাদের সংসারের খরচ চালিয়েছে। আজ সে ফুটবলের উচ্চ প্রশিক্ষণের জন্য পর্তুগাল যাচ্ছে, বিষয়টি আমাদের পৌরসভার জন্য খুবই খুশির সংবাদ।