শবে বরাত ফারসি ভাষার দুটি যুক্ত শব্দ। ‘শব’ শব্দের অর্থ রাত, ‘বরাত’ অর্থ নাজাত বা মুক্তি। আরবি ভাষায়ও বরাত শব্দের ব্যবহার আছে। এই দুই শব্দ মিলে অর্থ হয় মুক্তির রজনী।
হাদিসের ভাষায় এ রাতকে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ তথা ১৫ শাবানের রাত (১৪ তারিখ দিবাগত রাত) বলা হয়। এ রাতের ফজিলত সম্পর্কে কোরআন মাজিদে সরাসরি নির্দেশনা না থাকলেও হাদিস শরিফে নির্ভরযোগ্য সনদ বা বর্ণনাসূত্রে একাধিক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। বিখ্যাত সাহাবি মুয়াজ বিন জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ শাবানের রাতে অর্থাৎ শাবানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে তাঁর সৃষ্টির দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (ইবনে হিব্বান, হাদিস : ৫৬৬৫)
মুহাদ্দিসিনে কেরামের ভাষ্যমতে, হাদিসটির মান সহিহ তথা বিশুদ্ধ। এ জন্যই ইমাম ইবনে হিব্বান (রহ.) তার প্রসিদ্ধ হাদিসের রচিত কিতাব ‘কিতাবুস সহিহ’ এই হাদিসটি উল্লেখ করেছেন। তাছাড়া এসংক্রান্ত অনেক হাদিস আছে, যেগুলো এর অর্থকে শক্তিশালী করে। তাই এই রাত আসার আগেই শিরক ও হিংসা থেকে মুক্ত থেকে মহান আল্লাহর রহমতের আশায় থাকা মুমিনের কর্তব্য।
এ রাতের আমলের ব্যাপারে বিভিন্ন হাদিস থেকে বোঝা যায়, এই রাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) রাত্রি জাগরণ করেছেন এবং দীর্ঘ আমলে মশগুল ছিলেন। তবে এই রাতে বিশেষ পদ্ধতির কোনো ইবাদত তিনি আদায় করেননি এবং সাহাবায়ে কেরামদেরও তা করার নির্দেশ দেননি। তাছাড়া পূর্ববর্তী সালাফরা এ রাতে বিশেষ পদ্ধতির কোনো ইবাদত করেননি; বরং প্রত্যেকেই নিজ নিজ ব্যক্তিগত ইবাদতে মশগুল ছিলেন।
নিম্নে এ রাতে সালাফদের ইবাদত-বন্দেগি, পরের দিন রোজা ও তার ফজিলতের মূল্যায়ন নিয়ে তাদের কয়েকটি বক্তব্য তুলে ধরা হলো—
এ রাতের করণীয় সম্পর্কে সালাফদের বক্তব্য
১. ইবনে ওমর (রা.) বলেন, পাঁচটি রাত এমন আছে, যে রাতের দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। জুমার রাত, রজবের প্রথম রাত, শাবানের ১৪ তারিখ রাত, দুই ঈদের রাত। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, হাদিস: ৭৯২৭)
২. ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) আদি ইবনে আরতাতের উদ্দেশ্যে লেখেন, বছরের চারটি রাত তুমি অবশ্যই লক্ষ রাখবে। কেননা সেসব রাতে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়- রজবের প্রথম রাত, শাবানের ১৪ তারিখ রাত, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার রাত। (আত-তালখিসুল হাবির, ইবনে হাজার: ২/১৯১)
৩. ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন, আমাদের কাছে খবর পৌঁছে যে পাঁচ রাতে দোয়া কবুল হয়। জুমার রাত, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার রাত, রজবের প্রথম রাত ও শাবানের ১৪ তারিখ রাত। এ রাতগুলো সম্পর্কে যা বর্ণিত হয়েছে আমি সেগুলো মুস্তাহাব মনে করি, ফরজ মনে করি না। (আল-ইতিবার, পৃষ্ঠা : ১৪৩)
৪. শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, শাবানের ১৪ তারিখ রাতের ফজিলত রয়েছে। পূর্ববর্তী মুসলিম মনীষীদের অনেকেই এ রাতে সালাত পড়তেন। তবে সম্মিলিতভাবে মসজিদে সে রাত জেগে থাকা বিদআত; এমনকি দলবদ্ধভাবে জামাতে সালাত আদায় করাও বিদআত। (আল-ফাতওয়াল কুবরা, ইবনে তাইমিয়া: ১/১৩০১)
৫. ইমাম ইবনে রজব (রহ.) বলেন, একজন মুমিন বান্দার উচিত, এ রাতে জিকির ও দোয়ার জন্য পুরোপুরি অবসর হওয়া। প্রথমে খাঁটি মনে তওবা করা, এরপর মাগফিরাত ও ক্ষমা প্রার্থনা করা, আপদ-বিপদ দূর হওয়ার জন্য দোয়া করা এবং নফল নামাজ পড়া। (লাতাইফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা : ১৫১/১৫৭)
সালাফদের এসব বক্তব্য দ্বারা বোঝা যায়, এ রাতের ফজিলত ও ব্যক্তিগত আমল যুগপরম্পরায় প্রমাণিত। সুতরাং এই রাতের ফজিলত ও আমলকে ভিত্তিহীন বা বিদআত বলার সুযোগ নেই।
পরের দিন রোজা রাখা সম্পর্কে সালাফদের দৃষ্টিভঙ্গি
এ প্রসঙ্গে আলী (রা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ১৫ শাবানের রাত (১৪ তারিখ দিবাগত রাত) যখন আসে তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাও এবং দিনের বেলা রোজা রাখো। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৩৮৮)
এই বর্ণনাটির সনদ দুর্বল হলেও হাদিসের প্রথম অংশ- ইবাদতের বিষয়টি অন্যান্য হাদিস দ্বারা সমর্থিত। আর রোজার বিষয়টি শুধু এ বর্ণনায় রয়েছে। তবে কেউ যদি চায় এ মাসের ১৫ তারিখ রোজা রাখতে তাহলে সুযোগ রয়েছে। কেননা ১৫ তারিখ হলো আইয়ামে বিজের অন্তর্ভুক্ত। আইয়ামে বিজ অর্থাৎ প্রতি চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোজা রাখার বিষয়টিও সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। তাছাড়া শাবান মাসে বেশি বেশি নফল রোজা রাখার কথা সহিহ হাদিসে এসেছে।
এ প্রসঙ্গে আল্লামা ইবনে রজব হাম্বলি (রহ.) বলেন, শাবানের ১৫ তারিখ রোজা রাখতে নিষেধ নেই। কেননা ১৫ তারিখ হলো আইয়ামে বিজের অন্তর্ভুক্ত। আর প্রত্যেক মাসের এই তারিখে রোজা রাখা তো মুস্তাহাব। এ ছাড়া রাসুল (সা.) বিশেষভাবে শাবানের রোজা রাখতে বলেছেন। (লাতাইফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা : ১৮৯)
তবে উত্তম হলো ১৫ তারিখের সঙ্গে আগে পরে এক দিন মিলিয়ে নেওয়া, অন্যথায় শুধু এ দিন রোজা রাখার ব্যাপারে যত্নবান হওয়া মাকরুহ। এমনটাই বলেছেন শায়খ ইবনে তাইমিয়া (রহ.)।