রমজানের শেষ দশ দিনের গুরুত্ব অপরিসীম। এমনিতে রমজান সারা বছরের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। আর শেষ দশ দিন আরও গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়টা যেন ইবাদত-বন্দেগি ও জিকির-আজকারে কাটে, সে জন্য সদা সতর্ক থাকতে হয়।
এখানে রমজানের শেষ দশদিন ইবাদতে মুখরিত করার কিছু টিপস উল্লেখ করা হলো-
প্রথম টিপস : প্রতি রাতে অন্তত দুই রাকাত তাহাজ্জুদ
দুই রাকাত তাহাজ্জুদে দশ অথবা একশ কিংবা এক হাজার কোরআনের আয়াত তেলাওয়াতের চেষ্টা করুন। আপনার এ তাহাজ্জুদ যদি লাইলাতুল কদরের রজনীতে অধিভুক্ত হয়ে যায়, তাহলে আপনি এক রজনীতেই এক নাগাড়ে ৮৪ বছর ইবাদত করার পুণ্য লাভে ধন্য হবেন। আল্লাহর পছন্দের তালিকায় আপনি হয়ে যাবেন একান্ত অনুগত ইবাদতগুজার বান্দা।
আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রাতের সালাতে (তাহাজ্জুদে) দশটি আয়াত তিলাওয়াত করবে, তার নাম গাফিলদের তালিকায় লিপিবদ্ধ করা হবে না। আর যে ব্যক্তি (রাতের) সালাতে একশত আয়াত পাঠ করবে, তার নাম অনুগত বান্দাদের তালিকায় লিপিবদ্ধ করা হবে। যে ব্যক্তি সলাতে দাঁড়িয়ে এক হাজার আয়াত তেলাওয়াত করবে, তাকে অফুরন্ত পুরস্কার প্রাপ্তদের তালিকায় লিপিবদ্ধ করা হবে।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ১৩৯৮)
দ্বিতীয় টিপস: প্রতি রাতে তিনবার সুরা ইখলাস পাঠ
আপনার তিনবার সুরা ইখলাস পাঠ যদি কদর রজনীর পরশ পেয়ে যায়, তবে আপনি একটানা ৮৪ বছর প্রত্যেকদিন এক খতম কোরআন পাঠের সওয়াবের অধিকারী হতে থাকবেন। রাসূলের হাদিস-ই তার প্রমাণ। নবিজি (সা.) [একদিন] সাহাবাদের বললেন, তোমরা কি একরাতে কোরআনের এক তৃতীয়াংশ পাঠ করাকে সাধ্যাতীত মনে করো? সবাই জিজ্ঞেস করলেন, এক রাতে কোরআনের এক তৃতীয়াংশ কীভাবে পড়বো? তিনি বললেন, ‘“কুল হুওয়াল্ল-হু আহাদ”’ সুরাটি কোরআন মাজিদের এক তৃতীয়াংশের সমান। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৭৭১)
তৃতীয় টিপস: প্রতি রাতে সুরা বাকারার শেষ কয়েকটি আয়াত
রমজানের শেষ দশ দিনের প্রতি রাতে সুরা বাকারার শেষ কয়েকটি আয়াত পাঠে যত্নবান হোন। অর্থাৎ “لله ما في السماوات وما في الأرض”-থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠ করুন।
যদি আপনার উক্ত আয়াত পাঠ কদর রাতের অন্তর্ভুক্ত হয়, তাহলে লাগাতার ৩০ হাজার রাত নির্ঘুম আল্লাহর ইবাদতে কাটালে যে সওয়াব পাওয়া যায়, আপনার আমলনামায় এক রজনীতেই সে সওয়াব লিপিবদ্ধ করা হবে। কারণ, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যাক্তি সুরা বাকারার শেষের এ আয়াত দুইটি পড়বে, তা সে রাতে ওই ব্যক্তির জন্য যথেষ্ট হবে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৭৬৫)
প্রখ্যাত হাদিসবিশারদ ইবনে হাজার ব্যাখ্যায় লিখেছেন, ‘তার জন্য যথেষ্ট হবে মানে এই দুই আয়াত পাঠ পুরো রাত জেগে তাহাজ্জুদ পড়ার সওয়াব প্রাপ্তির জন্য যথেষ্ট হবে।’ তবে কেউ কেউ এ হাদিসের ভিন্ন ব্যাখাও দিয়েছেন।
চতুর্থ টিপস: এক টাকা করে সদকা করুন
শেষ দশকের প্রতি দিন এক টাকা করে দান করুন। আপনার দান-দক্ষিণা যদি লাইতুল কদরে পড়ে যায়, তাহলে আপনার আমলনামায় ৮৪ বছর পর্যন্ত প্রতিদিন সদকা দানের সওয়াব যুক্ত হতে থাকবে।
৫ম টিপস: প্রতিরাতে ১০০ বার নির্দিষ্ট জিকির করুন
রমজানের শেষ দশ দিনের প্রতি রাতে لا إله إلا الله وحده لا شريك له له الملك وله الحمد وهو على كل شيء قدير দোয়াটি পাঠ করুন। আপনার পাঠ যদি কদর রজনীর দেখা পেয়ে যায়, তবে আপনি ৩০ লাখ গোলাম আজাদ করার সওয়াব অর্জন করবেন। আর একটি গোলাম আজাদ করার দরুন জাহান্নাম থেকে নিষ্কৃতির ফায়সালা হয়ে যেতে পারে মর্মে হাদিসের ঘোষণা রয়েছে।
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কোনো মুসলিম অপর কোনো মুসলিম ক্রীতদাসকে মুক্ত করলে আল্লাহ তার (মুক্ত দাসের) প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বদলে তার (মুক্তিদাতার) প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাবেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৩৬৯০)
৬ষ্ঠ টিপস: এইভাবে নিম্নোক্ত দোয়াগুলো পড়ুন
প্রতি রাতে প্রথমে “سُبْحَانَ اللَّهِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ وَلاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ وَلاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللَّهِ” পড়ুন। এরপর ‘اللَّهُمَّ ارْحَمْنِي وَارْزُقْنِي وَعَافِنِي وَاهْدِنِي” -পড়ুন।
যদি আপনার এ পাঠ কদর রজনীতে শামিল হয়ে যায়, তাহলে আপনার হাত দুইটি ৩০ হাজার দিন পর্যন্ত কল্যাণের জোয়ারে ভাসতে থাকবে।
কারণ, নবী (সা.)-এর নিকট একলোক এসে বলল, আমি কোরআন মুখস্থ করতে পারি না। অতএব আমাকে এমন কিছু শিখিয়ে দিন যা কোরআনের পরিবর্তে যথেষ্ট হবে। নবী (সা.) বললেন, তুমি বলো- “সুবাহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার ওয়ালা-হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।” তখন লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! এটা তো মহা সম্মানিত আল্লাহর জন্য, আমার জন্য কি? নাবী(সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তুমি বলো: “আল্লাহুম্মা ইরহামানী, ওয়ারযুক্বনী, ওয়া ‘আফিনী ওয়াহদিনী।” বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর লোকটি ওগুলো হাতের অঙ্গুলিতে গণনা করল। তখন নবী (সা.) বললেন, এই লোক তার হাতকে উত্তম বস্তু দ্বারা পরিপূর্ণ করেছে। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৮৩২)
৭ম টিপস: “اللهم اغفر للمؤمنين والمؤمنات” দোয়াটি পড়ুন
আপনার এই দোয়া পড়াটা যদি লাইলাতুল কদরে হয়ে যায়, তাহলে আপনি একবার পাঠে ৬০ বিলিয়ন (৬-এর পর ১৩টি শূন্য বসালে ৬০ বিলিয়ন হয়) সওয়াব পেয়ে যাবেন। কারণ, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে মুমিন ব্যক্তি অন্যান্য মুমিন নারী-পুরুষের জন্য দোয়া করবে, সে পৃথিবীর সকল মুমিন নারী ও পুরুষের বিনিময়ে একটি করে সওয়াব পাবে।’ (আলবানি রহ. হাদিস টিকে সহিহ বলেছেন।)
উল্লেখ্য: পৃথিবীতে বর্তমানে ২.৫ বিলিয়ন মুসলিম রয়েছে। উল্লিখিত দোয়া একবার পাঠ করলে ২.৫ বিলিয়ন সওয়াব পেয়ে যাবেন। আর কদরের রাতে পাঠ করলে ৬০ বিলিয়ন সওয়াব মিলবে।
৮ম টিপস : ১০০ বার “سبحان الله” পাঠ করুন
যদি তা কদর রজনীর সাক্ষাত পেয়ে যায়, তাহলে আপনার আমলনামায় ৩০ মিলিয়ন সওয়াব লেখা হবে অথবা ত্রিশ মিলিয়ন গুনাহ মোচন করা হবে। কারণ, রাসুল (সা.) বলেছেন-“তোমাদের মধ্যে কি প্রতিদিন একহাজার পূণ্য কামাই করা অসাধ্য মনে করে এমন কেউ আছে? উপস্থিত একজন প্রশ্ন করলেন-প্রতিদিন একহাজার পুণ্য কীভাবে লাভ করা সম্ভব? তখন রাসুল (সা.) বললেন, ‘একশবার ‘সুবহানাল্লাহ’ পাঠ করবে, তাহলে আমলনামায় একহাজার পূণ্য যোগ করা হবে অথবা একহাজার গুণাহ মোচন করা হবে।”(মুসলিম)
৯ম টিপস: “سبحان الله العظيم وبحمده” -পাঠ করুন। এ পাঠ কদরের রজনীতে হলে, আপনার জন্য জান্নাতে তিন মিলিয়ন খেজুরগাছ রোপন করা হবে। কারণ, রাসুল (সা.) বলেছেন-“যে ব্যক্তি একবার “سبحان الله العظيم وبحمده” -পাঠ করবে, জান্নাতে তার জন্য একটি খেজুর গাছ রূপন করা হবে।” (আলবানি উক্ত হাদিসকে সহিহ বলে আখ্যা দিয়েছেন)
১০ম টিপস: ১০০ বার দরুদ পাঠ করুন
যদি তা লাইলাতুল কদরে প্রবিষ্ট হয়ে যায়, তবে আপনি রাজাধিরাজ মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ৩ মিলিয়ন রহমত প্রাপ্ত হবেন।
কারণ, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে আমার উপর একবার দরূদ পাঠ করবে আল্লাহ তার উপর দশবার রহমত করবেন।’
হাদিসে ব্যবহৃত -“صلاة” শব্দের ব্যাখ্যায় ইমাম শাওকানি (রহ.) লিখেছেন, ‘এখানে সালাত অর্থ রহমত। অর্থাৎ আল্লাহ তার বান্দাদের উপর বারবার রহমত করবেন; ফলে তার রহমতের সংখ্যা ১০-এ পৌঁছবে।’
১১তম টিপস: ১০০ বার “لا حول ولا قوة إلا بالله” -পড়ুন।
যদি তা শবে কদরে স্থান পায়, তাহলে আপনার জন্য জান্নাতে ৩ মিলিয়ন ধনভান্ডার গচ্ছিত রাখা হবে। কারণ, রাসুল (সা.) বলেছেন- “আমি কি তোমাদের এমন কালিমা বাতলে দেব না, যেটার বিনিময়ে জান্নাতে একটা ধনভান্ডার অর্জিত হয়? তা হলো- “لَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللّٰه ”
(সহিহ বুখারি)
১২তম টিপস:
سبحان اللهِ عدَدَ ما خلق*
*سبحان اللهِ مِلْءَ ما خلَق*
*سبحان اللهِ عدَدَ ما في الأرضِ والسماءِ*
*سبحان اللهِ مِلْءَ ما في الأرضِ والسماءِ**
*سبحان اللهِ عدَدَ ما أحصى كتابُه*
*سبحان اللهِ مِلْءَ ما أحصى كتابُه*
*سبحان الله ِعددَ كلِّ شيءٍ*
*سبحانَ اللهِ مِلْءَ كلِّ شيءٍ*
*الحمدُ للهِ عددَ ما خلق*
*الحمدُ لله مِلْءَ ماخلَق*
*الحمدُ لله عدَدَ ما في الأرضِ والسماءِ*
*الحمدُ لله مِلْءَ ما في الأرضِ والسماءِ*
*الحمدُ للهِ عدَدَ ما أحصى كتابُه*
*والحمدُ لله مِلْءَ ما أحصى كتابُه*
*والحمدُ للهِ عدَدَ كلِّ شيءٍ*
*والحمدُ للهِ مِلْءَ كلِّ شيء.
উল্লিখিত দোয়াগুলো প্রতিদিন ১০০ বার করে পাঠ করুন। যদি তা লাইলাতুল কদরে পড়ে, তবে ৩০ হাজার পুরো দিন-রাতের জিকির করার চাইতেও তা হবে আপনার জন্য শ্রেষ্ঠ জিকির।
হে আল্লাহ! আমাদের কামিয়াব করুন। আপনার জিকর, শোকর এবং উত্তমরূপে ইবাদত করার সামর্থ্য দান করুন। আল্লাহ! আপনি আমাদের তাদের মতো করে দিন, যারা আপনার কল্যাণকে কল্যাণ বুঝে নিয়েছে; ফলে আপনি তাদের সম্মানিত করেছেন।