৫০ টাকায় সরকারি চাকরি পেলেন দিনমজুরের মেয়ে বুলবুলি

ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ায় আগ্রহী ছিলেন বুলবুলি খাতুন। এই আগ্রহের জন্য তাকে একাধিকবার শুনতে হয়েছে ‘আজকাল টাকা ছাড়া চাকরি মেলে না। লেখাপড়া করে কী লাভ?‘ তবে অনেকে বিয়ের জন্য চাপ দিলেও বিয়ের পিড়িতে বসেননি বুলবুলি। তার বড় ভাই সামান্য রোজগারের টাকায় সংসার চালিয়ে তাকে মাস্টার্স পাশ করিয়েছে। আজ সেই সুফল ভোগ করছে তার পরিবার। মাত্র ৫০ টাকায় আবেদন করে সরকারি চাকরি পেয়েছেন বুলবুলি।

মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার চেংগাড়া গ্রামের দিনমজুর আজিজুল হকের মেয়ে তিনি। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের আয়া পদে চাকরি পেয়ে দিনমজুর বাবা-মা ও বড় ভাইয়ের কষ্ট সার্থক করেছেন। এখন বুলবুলি চাকরি করে সংসারের হাল ধরেত চান।

বুলবুলিসহ মেহেরপুরের আরও তিনজন চাকরি পেয়েছেন। বুধবার (৭ ডিসেম্বর) দুপুরে জেলা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর থেকে তারা নিয়োগপত্র গ্রহণ করেন।

জানা গেছে, গাংনীর চেংগাড়া গ্রামের দিনমজুর আজিজুল হকের চার ছেলে-মেয়ের মধ্যে বুলবুলি ছোট। বৃদ্ধ বাবা-মা বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছেন। বড় ভাই বুদু আলির দিনমুজুরির সামান্য আয়ে তাদের সংসার চলে। বুলবুলি ছোটবেলা থেকেই মেধাবী। পড়াশুনার প্রতি তার আগ্রহ দেখে একমাত্র ভাই স্বপ্ন দেখেন অন্য দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেলেও ছোট বোন বুলবুলিকে লেখাপাড়া করিয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করবেন। বুদু মিয়া দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালিয়ে বোনের লেখাপড়ার খরচ যোগাতেন।

বুলবুলি স্থানীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করে মেহেরপুর সরকারি কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স শেষ করে মাস্টার্স পাশ করেন। কিন্তু দিন আনা দিন খাওয়া সংসারে টাকা ছাড়া চাকরি হবে না ভেবে হতাশায় দিন কাটছিল তার। স্থানীয় এক স্কুল শিক্ষকের পরামর্শে ২০২১ সালে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে মাত্র ৫০ টাকা খরচ করে আয়া পদে চাকরির জন্য অনলাইনে আবেদন করেন। তার আবেদনের প্রেক্ষিতে লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পান। এ বছর ২৫ নভেম্বর তারিখে লিখিত পরীক্ষায় ভালো নম্বর পান বুলবুুলিসহ মোট ১৬ জন চাকরিপ্রার্থী। ২৯ নভেম্বর মেহেরপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলে সেখানেও তিনি ভালো ফল করেন। ১৬ জন প্রতিযোগীদের মধ্যে চারজন চাকরিপ্রত্যাশীকে নিয়োগের জন্য চূড়ান্ত করা হয়। যাদের মধ্যে বুলবুলি একজন। এ খবর শুনেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলেন না তিনি। তার সঙ্গে বিনাখরচে উক্ত পদে নিয়োগ পেয়েছেন মেহেরপুরের রিকতা খাতুন, নাজমুন্নাহার ও তাসমেরি খাতুন। বুধবার দুপুরে তারা নিয়োগ পত্র হাতে পান।

বুলবুলি খাতুন বলেন, আমাদের অভাবের সংসার। খেয়ে না খেয়ে লেখাপড়া করেছি। আমার বড় ভাই সংসার চালিয়ে লেখাপড়ার খরচ দিয়েছেন। গ্রামের অনেকেইে অনেক কথা বললেও ভাই কান দেননি। আমি আমার ভাইয়ের স্বপ্নপূরণ করতে লেখাপড়া করেছি। মাস্টার্স পাশ করার পর হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। শুনতাম টাকা ছাড়া নাকি চাকরি হয় না। আমার টাকা পয়সা দেয়ার সাধ্য বা সামর্থ্য কোনোটাই নেই। এক শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে চাকরির জন্য আবেদন করেছিলাম। ভাবতাম পরীক্ষার জন্য হয়তো ম্যাসেজ পাব না। কারণ আমাদের টাকাও নেই, আবার সুপারিশ করার মতো কেউ নেই। হঠাৎ দেখি আমার কাছে লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য ম্যাসেজ এসেছে। আমি লিখিত পরীক্ষা ৭০ নম্বর পেয়েছি। পরে মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ৩০ নম্বর পেয়েছি। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বার বার বলা হয়েছে কারো সাথে টাকা পয়সা লেনদেন না করার জন্য। বিনা পয়সায় চাকরি হয়েছে আমার। আমার মত অনেকেই আছে যারা মেধাবী। টাকা পয়সা খরচ করার সামর্থ্য নেই। আমার চাকরির মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো টাকা ছাড়া আমাদের দেশে সরকারি চাকরি হয়।

বুলবুলির বাবা আজিজুল হক বলেন, আমি বৃদ্ধ হয়েছি। আমার ছেলে আমাদের সংসার চালিয়ে মেয়ে বুলবুলির লেখাপড়া করিয়েছে। গ্রামের অনেকেই বলেছে মেয়েকে এতো বেশি পড়ালেখা করিয়ে কী হবে, বিয়ে দিয়ে দাও। কিন্তু আমার ছেলে তা না করে পড়ালেখা করিয়েছে। বিনাখরচে চাকরি পেয়েছে আমার মেয়ে। জেলা প্রশাসকসহ সরকারকে আমি ধন্যবাদ জানাই।

তার বড়ভাই বুদু মিয়া জানান, অনেক বাধা বিপত্তি পেড়িয়ে বুলবুলিকে লেখাপড়া করিয়েছি। গ্রামে বসবাস করে বোনকে বিয়ে না দিয়ে লেখাপড়া করাতে গিয়ে অনেকেই অনেক কটু কথা বলেছেন। পরের মেয়ে ঘরে আনলে বোনের লেখাপাড়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে এমন ভাবনায় আজও বিয়ে করিনি। আমার বোন আজ বিনা টাকায় চাকরি পেয়ে আমার পরিশ্রম সার্থক করেছে। আমি সরকার ও ডিসি স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।

প্রতিবেশী ঝর্ণা খাতুন বলেন, বিনাটাকায় চাকরি মেলে এমন কথা ভাবতেই পারিনি। যে যাই বলুক না কেন মন দিয়ে লেখাপড়া করলে আমাদের দেশেও ঘুষ ছাড়া চাকরি হয়।

গাংনী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মৌসুমী খানম বলেন, ঘুষ আর দুর্নীতি থেকে দূরে থাকতে সকল চাকরিপ্রত্যাশীদের বারবার বলা হয়েছে। নিজের মেধা আর যোগ্যতা থাকলে চাকরি মানুষকে খুঁজে বেড়াতে হয় না। জেলা প্রশাসক স্যারের নির্দেশনা ছিল দালালদের খপ্পরে যেন কেউ না পড়েন। সে বিষয়টি আমরা সর্বক্ষণ মনিটরিং করেছি। বুলবুলি সেই দৃষ্টান্ত। দিন আনা দিন খাওয়া পরিবারে বেড়ে ওঠা একটি মেয়ে মেধার ওপর ভিত্তি করে সরকারি চাকরি পেয়েছে। সে ভবিষ্যতে আরও ভালো কিছু করবে। মেয়েদের বাল্যবিয়ে না দিয়ে লেখাপড়া করানোর জন্য প্রতিটি পরিবারের উদ্যোগী হওয়া উচিত।

মেহেরপুর জেলা প্রশাসক ড.মুনসুর আলল খান বলেন, মানুষের ধারণা বদলে দিতে চাই। দেশ বদলেছে। কোনোরকম অবৈধ লেনদেন ছাড়াই মেধাবীরা চাকরি পাচ্ছেন। গাংনীর বুলবুলি বর্তমান সরকারের এটি একটি বাস্তব দৃষ্টান্ত। ভালভাবে লেখাপাড়ায় মনোনিবেশ করলে চাকরির জন্য টাকা লাগে না। আমি জেলা প্রশাসক হিসেবে সকল চাকরির ক্ষেত্রে এ ধারা অব্যাহত রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

নিউজটি শেয়ার করতে নিচের বাটনগুলোতে চাপ দিন

Facebook
Twitter
WhatsApp
LinkedIn
Print

আপনার মতামত প্রকাশ করুন

এ বিভাগের আরো খবর

ফেসবুক পেজে লাইক দিন

বিভাগীয় সংবাদ