ভেঙে পড়ছে পাকিস্তানের টেক্সটাইল খাত

স্বাধীনতা লাভের সাত দশকের বেশি সময়ের মধ্যে এবারে নজিরবিহীন এক অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে পাকিস্তান। দেশটির এই সংকট এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যে অনেক অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ, দেশটির দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। হাজার হাজার মানুষ খাদ্য-বস্ত্র ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর ঘাঁটতির মুখোমুখি হয়েছেন।

প্রত্যেক দিনই পণ্যসামগ্রীর দাম হু হু করে বাড়ছে, সবকিছু চলে যাচ্ছে মানুষের নাগালের বাইরে। এমন পরিস্থিতি চাকরি হারিয়ে বেকারত্ব বরণ করছেন কোটি কোটি মানুষ। দেশটির অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি টেক্সটাইল শিল্পও ভেঙে পড়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে।

এই সংকট নিয়ে ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে একটি নিবন্ধ লিখেছেন পাকিস্তানের ফয়সালাবাদের টেক্সটাইল শিল্পের শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন উইমেন ওয়ার্কার্স অ্যালায়েন্সের (ডব্লিউডব্লিউএ) পারভীন লতিফ আনসারি।

পাকিস্তানের একসময়ের সমৃদ্ধ টেক্সটাইল শিল্পের নারী শ্রমিকরা বছরের পর বছর ধরে ডেনিম থেকে শুরু করে তোয়ালে পর্যন্ত নানা ধরনের পণ্য ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরবরাহ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারির পর রপ্তানি হ্রাস এবং ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হওয়ার কারণে পাকিস্তানে ৭০ লাখ শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছেন। আমার শহর ফয়সালাবাদে ১৩ লাখ টেক্সটাইল শ্রমিক; যাদের মধ্যে লাখ লাখ নারী আছেন, তারা চাকরি হারিয়েছেন এবং বিপুলসংখ্যক মানুষ চাকরি হারানোর দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন।

ফয়সালাবাদের নারী টেক্সটাইল শ্রমিকদের জন্য সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হল তাদের চাকরি চিরতরে হারিয়ে যাবে। আর এই চাকরি চলে যাওয়া কর্মক্ষেত্রে তারা যে হয়রানির মুখোমুখি হন এবং যেখানে কোনও স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা নেই সেসবের তুলনায় তাদের বিলম্বে পাওয়া কম বেতনের চেয়েও ভয়াবহ কিছু।

যে গ্রামীণ নারীরা একেবারে ভোরবেলা আশপাশের এলাকা থেকে কারখানায় যান এবং কম বেতনের বিনিময়ে সারাদিন কাজ করেন; এই চাকরিই তাদের আয়ের একমাত্র উৎস। পাকিস্তানের ম্যানচেস্টার নামে পরিচিত আমার শহর ফয়সালাবাদ এবং বিশ্বের জন্য টেক্সটাইল উৎপাদন করে। কিন্তু এই শিল্পের ওপর প্রবল চাপ তৈরি হয়েছে। বিদ্যুতের ব্যয় দ্বিগুণ হয়েছে; বন্যায় তুলার ক্ষেত ধ্বংস হয়েছে। এর ওপর সরকার ঋণের সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে।

শত শত কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে অথবা শিফটের ভিত্তিতে স্বল্প সময়ের জন্য কাজ করছে। শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এমনকি নারী শ্রমিকদের কুটির শিল্প, বাড়িতে সেলাইয়ের ক্ষেত্রেও সরকারি সহায়তা কিংবা প্রণোদনার ঘাটতি রয়েছে। তারা দৈনিক এক ডলারেরও কম মজুরিতে গ্লাভস, মোজা এবং স্টকিংস তৈরি করেন। আমি বিশ্বাস করি, এই শিল্পকর্মের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে এবং সরকারের উচিত শ্রমিকদের সম্মানজনক মজুরি নিশ্চিত করে এটিকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করা।

পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে বাসাবাড়ি-ভিত্তিক শ্রমিকরা আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রমিক হিসেবে নিবন্ধনের সুযোগ পেয়েছেন। নতুন এই স্বীকৃতি তাদের সরকারি-বেসরকারি নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেতে সহায়তা করবে।

উইমেন ওয়ার্কার্স অ্যালায়েন্স (ডব্লিউডব্লিউএ) টেক্সটাইল শিল্পে গণ ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে এবং শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধের দাবি তুলেছে। আমি শ্রম আইন এবং সামষ্টিক অধিকার নিয়ে শত শত নারীর সাথে শিক্ষামূলক সেশন পরিচালনা করেছি। কিন্তু সেখানে এখনও সচেতনতার অভাব রয়েছে। আমার ধারণা, মোজা, গ্লাভস বা স্টকিংস তৈরি খাতের দেড় লাখেরও বেশি শ্রমিকের মধ্যে মাত্র ৪ হাজার ২০০ জনের সামাজিক সুরক্ষা কার্ড রয়েছে।

চাকরি হারানোর ভয়ে নিজের অধিকারের পক্ষে কথা বলতে নারাজ নারী শ্রমিকরা। টেক্সটাইল খাত ও অন্যান্য শিল্পের নারীদের হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠন করতে সাহায্য করেছে ডব্লিউডব্লিউএ। আমরা হয়রানি বিরোধী কমিটি গঠনের বিষয়ে সরকারের শ্রম বিভাগের সাথেও বৈঠক করেছি। শুধু তাই নয়, বর্তমানে ফয়সালাবাদের ৪০টি কারখানায় এই কমিটি গঠনে সফল হয়েছি।

তবে এখানে মূল সমস্যা হলো ইউনিয়নের যেকোনও ধরনের কর্মকাণ্ডের জন্য আমরা কর্মক্ষেত্রে গিয়ে নারীদের সাথে দেখা করতে পারি না। এছাড়া মালিকরা তাদের বাসে করে কারখানায় নিয়ে যান। তিন মাস আগে মাসুদ টেক্সটাইল কারখানার শ্রমিকরা ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করতে সফল হয়েছিল। আর এ জন্য আমাদের প্রায় চার মাস ধরে লড়াই করতে হয়।

ছোট ছোট কারখানাগুলোতে শ্রম আইন মানা হয় না। এমনকি নারী শ্রমিকরা মাতৃত্বকালীন ছুটিও পান না। এসব কারখানায় নারীদের প্রতি তেমন কোনও সহানুভূতিও দেখানো হয় না। তবে তা সত্ত্বেও আমি আশাবাদী যে, শ্রমিকদের কাজ ফিরবে, কারখানায় নারীরা তাদের অধিকার সম্পর্কে আরও সচেতন হবেন এবং সম্মানজনক মজুরি আর আর্থিক স্বাধীনতার নিশ্চয়তার মাধ্যমে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জয়ী হবেন।

নিউজটি শেয়ার করতে নিচের বাটনগুলোতে চাপ দিন

Facebook
Twitter
WhatsApp
LinkedIn
Print

আপনার মতামত প্রকাশ করুন

এ বিভাগের আরো খবর

ফেসবুক পেজে লাইক দিন

বিভাগীয় সংবাদ