বগুড়ার শেরপুরের বাঙালি নদী ঘেঁষা গ্রাম চক কল্যাণী। বাঁকের ওপর হওয়ায় প্রতি বছর ভাঙনের প্রভাবে গ্রামটির তিন ভাগের এক ভাগ টিকে আছে। পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) পর্যন্ত নতুন করে ভেঙেছে বাঁধের অন্তত সোয়া ১০০ মিটার। এতে ধসে পড়েছে ঘর। হুমকির মুখে পড়েছে আশপাশের আরও অন্তত ৩০ গ্রামের আবাদি জমি।
স্থানীয়দের দাবি, গত এক যুগে এই এলাকার প্রায় দেড়শ বিঘা আবাদি জমি ও বসতবাড়ি নদী ভাঙনে বিনষ্ট হয়েছে। চক কল্যাণী গ্রামের বাঁধটি সংস্কারে স্থানীয়রা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় তাদের শঙ্কা দিন দিন বাড়ছে।
গ্রামের বাসিন্দারা জানান, প্রায় এক যুগ ধরে চক কল্যাণী গ্রাম ভাঙছে। কিন্তু দেখার কেউ নেই। কয়েক মাস আগে নদী রক্ষার কাজ শুরু করলেও হঠাৎ পানি বৃদ্ধি পেলে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। এ বছর ২ সেপ্টেম্বর থেকে বৃষ্টিপাত শুরু হয়। সেই সঙ্গে নদীতে ভাঙন দেখা দেয়। ভাঙন শুরু হলেও জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কেউ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে ভাঙনে বেড়ি বাঁধের প্রায় সোয়া ১০০ মিটার নদীগর্ভে চলে গেছে। সঙ্গে নিয়ে গেছে গ্রামের বাসিন্দা নজরুল, আবু বক্কর ও শেফালীর বাড়ির প্রায় সবটুকু। টিকে থাকা বাড়ি সরাতে গিয়ে বৃহস্পতিবার সকালে ঘাড়ে আঘাত পেয়ে গুরুতর আহত হন নজরুল ইসলাম।
নজরুল ইসলামের মেয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী তানজিলা আক্তার মিশু বলেন, আমরা এখন প্রতিনিয়ত প্রাণ সংশয়ের আতঙ্ক নিয়ে দিন কাটাচ্ছি। আমাদের বাড়ি-আবাদি জমি কয়েকবার ভেঙেছে। এবার পাঁচ শতকের বাড়ি ধসে গেছে। এটি ছিল একেবারে বাঁধের নিচে। আমরা পথে বসে যাওয়ার অবস্থায় চলে গেছি। বাড়ির দক্ষিণ পাশে ছোট একটি কবরস্থান আছে। এর ধারে আরও চারটি বাড়ি নদী ভাঙনের ঝুঁকিতে আছে।
তানজিলা আক্তার আক্ষেপ করে বলেন, কল্যাণী গ্রামের নদীর তীর রক্ষায় ৫০০ মিটার পাকা বাঁধ তৈরির প্রকল্প ছিল। কিন্তু ২০০ মিটার কাজ হওয়ার পর বন্ধ আছে। আরও আগে এই বাঁধ নির্মাণ করতে পারলে আজ আমাদের ঘরহারা হওয়া লাগতো না।
একই গ্রামের বাসিন্দা ওমর ফারুক হৃদয় জানান, প্রায় ১০-১২ বছর ধরে এখানে ভাঙছে। কল্যাণী গ্রামের মৌজার বেশিরভাগই নদী ভাঙনে হারিয়েছেন। এখানে একটা কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় মাস দুয়েক আগে থেকে সেটি বন্ধ রেখেছে। অথচ তারা এই কাজ শুকনো মৌসুমে করতে পারতেন।
ওমর ফারুক বলেন, ভাঙে প্রতি বছর, কিন্তু কেউ দেখে না। আমরা অনেকবার মানববন্ধন করেছি। সরকারি দপ্তরে বলেছি। এবারের ভাঙনে বেড়ি বাঁধের রাস্তা ধসে গেছে। এই রাস্তা দিয়ে শেরপুর ও ধুনট উপজেলার বথুয়াবাড়ি, জালশুকা, চাঁনদিয়াড়, চকধলী, চক কল্যাণী, গুয়াগাছি, জয়লা-জুয়ান, বেলগাছি, জয়নগর, সুঘাট, ও পাঁচথুপি-সরোয়াসহ ৫০ গ্রামের মানুষ যাতায়াত করে থাকেন। এখন তারা সবাই চলাচলের সংকটে পড়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিগত ১৯৮৭ সালে জেলার ধুনট উপজেলার বথুয়াবাড়ি থেকে শেরপুর উপজেলার সাহেববাড়ী ঘাট পর্যন্ত বাঙালি নদীর পূর্ব তীরে ১০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করেন সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্প (ডিআইডিপি) নামে একটি বেসরকারি সংস্থা। ওই সময় বাঁধটি নির্মাণের ফলে ধুনট উপজেলার চৌকিবাড়ি, মথুরাপুর, গোপালনগর এবং শেরপুর উপজেলার সুঘাট, সীমাবাড়ী ইউনিয়ন ও সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার প্রায় আড়াই লাখ পরিবার বন্যার ক্ষতি থেকে রক্ষা পায়।
কিন্তু পরবর্তীতে এই বেড়ি বাঁধের তেমন কোনো সংস্কার হয়নি। ধীরে ধীরে বাঁধটি আবার ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়ে। ২০০৯ সালের দিকে বাঁধের চক কল্যাণী গ্রামের অংশে বড় ভাঙন হয়। এরপর প্রতিবছর ভাঙতেই থাকে। এই ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালে আবার বড় ভাঙন হয় সেখানে।
সুঘাট ইউনিয়ন পরিষদ সূত্র জানায়, গত এক যুগে কল্যাণী গ্রামের মানুষ নদী ভাঙনের শিকার হয়ে বিভিন্ন স্থানে সরে গেছে। বেশির ভাগ উঠে গিয়ে বীর জয় সাগর গ্রামে বসতি গড়েছে। ওই গ্রামের বাসিন্দাদের অন্তত ১০০ বিঘা জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। আর কল্যাণী গ্রামের যারা আছেন তাদের অন্তত ৩০ বিঘা নদীতে বিলীন হয়েছে। এখন চক কল্যাণী মৌজার তিন ভাগের এক ভাগ টিকে আছে।
সুঘাট ইউপি চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান জিন্নাহ বলেন, গতকাল বুধবার পর্যন্ত বাঁধের ১০০ মিটার ভেঙেছে। আজ আরও প্রায় ১৫-২০ মিটার ভাঙছে। এই বেড়ি বাঁধ পুরোপুরি ভেঙে গেলে এ অঞ্চলের ২০ গ্রামের ফসলি জমি নষ্টের হুমকিতে পড়বে। আমি পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা কাজ শুরু করার কথা জানিয়েছেন। কিন্তু তারা আরও আগে নদী রক্ষার পদক্ষেপ নিলে আজকের এই মানুষগুলো ক্ষতির সম্মুখে পড়তেন না।
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের নভেম্বরে ২ হাজার ৩৩৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে নাব্য ফেরানো, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, ভাঙন রোধ এবং শুষ্ক মৌসুমে পানি ধরে রাখার মাধ্যমে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ জীববৈচিত্র সংরক্ষণের জন্য পাউবোর পক্ষ থেকে গেল বছরের মাঝামাঝি ‘বাঙালি-করতোয়া-ফুলজোড়-হুরাসাগর নদী সিস্টেম ড্রেজিং/পুনঃখনন ও তীর সংরক্ষণ’ নামে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল চলতি বছরের জুন মাসে। পরে করোনার কারণে মেয়াদ বাড়িয়ে সময়সীমা করা হয় ২০২৪ সালের জুন মাসে।
ওই প্রকল্পের আওতায় বাঙালি নদীর ২২টি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পরবর্তীতে আরও ৭টি পয়েন্ট নির্ধারণ করে পাউবো। এসব স্থানে ব্লক দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে সাহেববাড়ি, বথুয়াবাড়ীর কাজ শেষের দিকে। একই রকমভাবে চক কল্যাণী এলাকার ৫০০ মিটার বাঁধ নির্মাণ হবে। বাঁধের ২০০ মিটার কাজ হয়েছে।
শেরপুর শাখার উপ সহকারী প্রকৌশলী নিবারণ চক্রবর্তী বলেন, বাঙালি নদীতে অসংখ্য টার্নিং পয়েন্ট (বাঁক)। চক কল্যাণীতেও তেমনি এল শেপ বাঁক রয়েছে। এ জন্য পানি বাড়লে ঘূর্ণিপাক হয়ে বাঁধের নিচের দিকের মাটি সরে যায়। এরপর ওপর থেকে ধস নামে। আমাদের ওই এলাকায় কাজ চলমান ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছে। পানি নেমে গেলেই সেখানে আবার কাজ শুরু হবে। আর ওই প্রকল্পের বরাদ্দ থেকে চক কল্যাণীর ভাঙন পয়েন্টে জরুরি পদক্ষেপ হিসেবে জিও ব্যাগ ফেলা হবে। ঠিকাদারকে তাড়াতাড়ি করার জন্য বলা হয়েছে। আশা করছি জিও ব্যাগ ফেলার পর আমরা গ্রামবাসীদের বাড়িঘর রক্ষা করতে পারব।