হজ ইসলামের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান। মুসলিম উম্মাহর বাৎসরিক ঐক্য ও সংহতির বিশ্ব সম্মেলন। আল্লাহ তাআলার বান্দাদের মধ্যে যারা সামর্থ্যবান— তাদের ওপর তিনি হজ ফরজ করেছেন।
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘আর প্রত্যেক সামর্থ্যবান মানুষের ওপর আল্লাহর জন্য বায়তুল্লাহর হজ করা অবশ্য কর্তব্য।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ৯৭)
মূলত মৌলিক ইবাদত তিন ধরনের হয়ে থাকে। এক. শারীরিক, যেমন- নামাজ, রোজা। দুই. আর্থিক, যেমন- জাকাত, ফিতরা। তিন. আর এমন কিছু আমল আছে, যা শারীরিক ও আর্থিক উভয় প্রকার হয়ে থাকে, যেমন- হজ, ওমরাহ ইত্যাদি। এ কারণেই আল্লাহ তাআলা এ কাজটি অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ করেছেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনোরূপ অশ্লীল কথা বা গুনাহর কাজে লিপ্ত না হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে হজ সম্পন্ন করে, সে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসে।’ (বুখারি, হাদিস : ১৫২১)
আল্লাহর রাসুল (সা.) আরো বলেছেন, ‘কবুল হজের পুরস্কার হলো জান্নাত।’ (বুখারি, হাদিস : ১৭৭৩)
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, সর্বোত্তম আমল কোনটি? তিনি বললেন, ‘আল্লাহ ও তার রাসুলের ওপর ইমান আনয়ন করা।’ পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলো, এরপর কোনটি? তিনি বললেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা।’ পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলো, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, ‘হজে মাবরুর করা।’ (অর্থাৎ মকবুল হজ করা)। (বুখারি, হাদিস : ১৪২৯)
আর হজ মূলত তিন প্রকার। তামাত্তু, কিরান ও ইফরাদ। এখানে প্রত্যেক প্রকারের হজ কীভাবে আদায় করতে হয় সবিস্তারে সেগুলো আদায় করার পদ্ধতি বর্ণনা করা হলো।
আল্লাহর ঘর পবিত্র কাবা একবার ছুঁয়ে দেখার মধুময় চেষ্টা…
তামাত্তু হজ আদায়ের পদ্ধতি
বাংলাদেশ থেকে যারা পবিত্র হজে গমন করেন, তারা সাধারণত তামাত্তু হজ আদায় করে থাকেন। তামাত্তু হজকারীদের, অর্থাৎ মধ্যখানে হালাল হয়ে পৃথক দুইটি ইহরামে যারা হজ ও ওমরাহ পালন করবেন, তাদের নিম্নবর্ণিত কাজগুলো ধারাবাহিকভাবে আদায় করতে হবে। ৮ জিলহজের আগেই তাদের ওমরাহ পালন করতে হবে। তারপর ৮ জিলহজ থেকে হজের কাজগুলো সম্পন্ন করতে হবে।
♦ মক্কা শরিফ গমনকারীদের নিজ নিজ মিকাত অতিক্রমের আগেই ওমরাহর নিয়তে ইহরাম বাঁধা ফরজ। অর্থাৎ সেলাইবিহীন দুটি সাদা কাপড় পরিধান করে দুই রাকআত নফল নামাজ আদায় করে শুধু ওমরাহর নিয়ত করবে এবং এভাবে তালবিয়া পড়বে : ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হাম্দা, ওয়ান্নি’মাতা লাকা ওয়ালমুলক, লা শারিকা লাকা। ‘ (বুখারি : ১৪৪৮)
♦ মিকাত পরিচয়ে অক্ষম ব্যক্তিদের বিমানবন্দরে পৌঁছার আগে অথবা বিমানবন্দর থেকেই ইহরাম বেঁধে নিতে হবে।
♦ তারপর ওমরাহ করা, অর্থাৎ ওজুর সঙ্গে বাইতুল্লাহ শরিফ তাওয়াফ করা ফরজ। এ তাওয়াফ এবং যেসব তাওয়াফের পর ‘সাঈ’ করা হয়, সেসব তাওয়াফের সময় দুটি বিষয় লক্ষণীয়। এক. ‘ইজতিবা’, অর্থাৎ ডান হাতের নিচ দিক থেকে ইহরামের কাপড় বাঁ কাঁধে রাখা মুস্তাহাব। দুই. প্রথম তিন চক্করের সময় ‘রমল’ করা; অর্থাৎ পুরুষরা দ্রুতগতিতে বীরদর্পে চলা সুন্নাত। তাওয়াফ শেষে সম্ভব হলে মাকামে ইব্রাহিমের পেছনে, অন্যথায় হারাম শরিফের যেকোনো স্থানে (মাকরুহ সময় ছাড়া) দুই রাকআত নামাজ পড়া ওয়াজিব। তারপর সাফা-মারওয়া পাহাড়ে সাতবার ‘সাঈ’ করা ওয়াজিব।
♦ অতঃপর পুরুষদের মাথা মুণ্ডানো বা পুরো মাথা ছাঁটানো আর মহিলাদের চুলের এক ইঞ্চি পরিমাণ কেটে ফেলা ওয়াজিব। এতেই ওমরাহ সমাপ্ত হয়ে যায়। তারপর ইহরাম খুলে যাবতীয় কাজ স্বাভাবিকভাবে করা যাবে। এর পর থেকে হজের কার্যক্রম শুরু।
৮ জিলহজ করণীয়
তামাত্তু হজকারীদের ৮ জিলহজ হুদুদে হারামের যেকোনো স্থান থেকে তথা নিজ বাসা, ঘর, হারাম শরিফ থেকে হজের নিয়তে পুনরায় ইহরাম বেঁধে জোহরের আগে মিনায় পৌঁছতে হবে। ৮ তারিখ জোহর থেকে ৯ তারিখ ফজর পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মিনায় আদায় করা সুন্নাত।
৯ জিলহজ করণীয়
♦ জিলহজের ৯ তারিখ সূর্যোদয়ের কিছুক্ষণ পর মিনা থেকে আরাফার দিকে যাত্রা করবে। সেদিন সূর্য হেলার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফায় অবস্থান করা ওয়াজিব। তাঁবুতে অবস্থানকারীগণ জোহর ও আসর নামাজ নিজ নিজ সময়ে মুকিম হলে চার রাকআত এবং মুসাফির হলে দুই রাকআত করে আদায় করবেন। তবে মসজিদে ‘নামিরার’ জামাতে পড়লে একসময়েও আদায় করা যাবে। স্মরণ রাখতে হবে যে আরাফার সঠিক সীমান্তে পৌঁছতে ভুল করলে হজ আদায় হবে না।
♦ সূর্যাস্তের পর মাগরিব না পড়েই মুজদালিফার উদ্দেশে রওনা হতে হবে। মাগরিবের ওয়াক্ত চলে গেলেও, রাত গভীর হলেও মুজদালিফায় পৌঁছার পরেই মাগরিব ও এশার নামাজ একত্রে পড়তে হবে। কেননা মুজদালিফায় পৌঁছে মাগরিব ও এশা এক আজান ও দুই ইকামতে একসঙ্গে আদায় করা ওয়াজিব। এখানে রাত যাপন করা সুন্নাত আর ১০ জিলহজ ফজরের পর সূর্যোদয়ের আগে কিছু সময় মুজদালিফায় অবস্থান করতে হবে। কেননা ১০ তারিখ সুবহে সাদিকের পর কিছু সময় মুজদালিফায় অবস্থান করা ওয়াজিব। তবে দুর্বল ও মহিলাদের জন্য রাতেই মিনার উদ্দেশে রওনা হওয়া বৈধ।
১০ জিলহজ যেসব করণীয়
♦ জিলহজের ১০ তারিখ সুবহে সাদিকের পর কিছু সময় মুজদালিফায় অবস্থান করে মিনার উদ্দেশে যাত্রা করবে এবং মিনায় পৌঁছে কেবল বড় জামিরায় (শয়তানকে) সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব। ১০ তারিখ সুবহে সাদিকের পর থেকে পরদিন সুবহে সাদিকের পূর্ব পর্যন্ত যেকোনো সময় এই কঙ্কর নিক্ষেপ করা যাবে। যদি এই সময়ের মধ্যে কঙ্কর নিক্ষেপ করা না হয়, তবে দম দিতে হবে। এটি সূর্যাস্তের আগে করতে পারলে ভালো।
♦ ১০ জিলহজ কঙ্কর মারার পরই দমে শোকর বা দমে তামাত্তু- যাকে হজের কোরবানি বলা হয়, নিশ্চিত পন্থায় তা আদায় করা ওয়াজিব। কোরবানির পরেই মাথা হলক করা ওয়াজিব। তবে চুল ছোটও করা যাবে। মনে রাখতে হবে, হাদি বা কোরবানির পশু অন্যকে দিয়ে জবাই করানো হলে জবাইয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া জরুরি।
♦ কোরবানির পর মাথা মুণ্ডানো বা ছাঁটানোর পর ইহরাম খুলে সব কিছুই স্বাভাবিকভাবে করতে পারবেন, এমনকি স্বাভাবিক কাপড় পরেও তাওয়াফে জিয়ারত করা যাবে। তবে তাওয়াফে জিয়ারতের আগে স্বামী-স্ত্রী মিলন বৈধ হবে না।
♦ কঙ্কর মারা, কোরবানি করা ও চুল কাটার মধ্যে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা ওয়াজিব, ব্যতিক্রম হলে ‘দম’ দিতে হবে।
♦ তাওয়াফে জিয়ারত বা হজের ফরজ তাওয়াফ করে সাফা-মারওয়া ‘সাঈ’ করা ওয়াজিব। সম্ভব হলে সেই তাওয়াফ ১০ তারিখে করা ভালো। অন্যথায় ১২ তারিখ সূর্যাস্তের আগে আগেই আদায় করা ওয়াজিব। হলক বা মাথা মুণ্ডানোর পরই এই তাওয়াফ করা সুন্নাত। তবে কারণবশত এর আগেও বৈধ আছে। তাওয়াফে জিয়ারতের পর স্বামী-স্ত্রী মিলনও বৈধ হয়ে যায়।
♦ ১০ তারিখ দিবাগত রাত মিনায় যাপন করা সুন্নাত।
জিলহজের ১১-১২ ও ১৩ তারিখ করণীয়
১১, ১২ তারিখে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় জামারায় উভয় দিন সাতটি করে ২১টি কঙ্কর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব। ছোট জামারা থেকে শুরু করে বড় জামারায় তা শেষ করবে। সূর্য হেলার পর থেকে পরদিন সুবহে সাদিকের আগ পর্যন্ত যেকোনো সময় এই কঙ্কর নিক্ষেপ করা যাবে। সূর্যাস্তের আগে সম্ভব হলে ভালো। তবে বিশেষজ্ঞদের মতানুসারে সূর্য হেলার আগে নিক্ষেপ করলে আদায় হবে না; বরং সূর্য হেলার পর আবার নিক্ষেপ করতে হবে। অন্যথায় ‘দম’ দিতে হবে। এটাই নির্ভরযোগ্য ফতোয়া। তবে অতি ভিড় বা অন্য কোনো অসুবিধার কারণে সূর্য হেলার আগে নিক্ষেপ করলে ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর এক বর্ণনামতে বৈধ হয়ে যাবে।
♦ ১৩ তারিখ সূর্য হেলার পর কঙ্কর নিক্ষেপ করে মিনা ত্যাগ করা সুন্নাত। তবে কেউ যদি ১২ তারিখে চলে আসতে চান, তাহলে ওই দিন সূর্য হেলার পর থেকে পরদিন সুবহে সাদিকের আগ পর্যন্ত যেকোনো সময় পাথর মেরে চলে আসতে পারবেন। কিন্তু যদি কেউ ১৩ জিলহজ সুবহে সাদিকের পর মিনায় অবস্থান করেন, তাহলে তাঁর জন্য ১৩ তারিখেও কঙ্কর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব। অন্যথায় ‘দম’ দিতে হবে। ১২ তারিখের পর একজন হাজি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবেন।
♦ তারপর মিনা থেকে মক্কা এসে বিদায়ী তাওয়াফ করা ওয়াজিব। বাংলাদেশি হজযাত্রীদের হজ শেষে বিদায়ী তাওয়াফ করতে হয়, এটি ওয়াজিব। তবে হজ শেষে যেকোনো নফল তাওয়াফই বিদায়ী তাওয়াফে পরিণত হয়ে যায়। নারীদের মাসিকের কারণে বিদায়ী তাওয়াফ করতে না পারলে কোনো ক্ষতি নেই; ‘দম’ দিতে হয় না।
♦ মিনার দিনগুলোতে মিনায়ই রাত যাপন করা সুন্নাত।
হজে কিরান আদায়ের পদ্ধতি
কিরান হজকারীদের জন্য, অর্থাৎ মাঝখানে হালাল না হয়ে একই ইহরামে যারা হজ ও ওমরাহ পালন করবেন, তাঁদের মিকাত অতিক্রমের আগেই একসঙ্গে হজ ও ওমরাহর নিয়তে ইহরাম বাঁধা ফরজ। আর মক্কা শরিফ পৌঁছে ওমরাহ তথা তাওয়াফ করা, দুই রাকআত নামাজ পড়া, ‘সাঈ’ করা অতঃপর ইহরাম অবস্থায়ই থাকতে হবে। সম্ভব হলে এ সময় তাওয়াফে কুদুম বা আগমনী তাওয়াফ করা সুন্নাত।
আগের ইহরামেই ৮ তারিখ জোহরের আগে মিনায় পৌঁছে যেতে হবে। আর বাকি দিনগুলোতে- অর্থাৎ জিলহজের ৯, ১০, ১১, ১২ ও ১৩ তারিখ হজে তামাত্তু-এ উল্লিখিত নিয়মে করণীয়গুলো পালন করতে হবে।
হজে ইফরাদ আদায়ের পদ্ধতি
ইফরাদ হজকারীদের জন্য, অর্থাৎ যারা ওমরাহ ছাড়া কেবল হজের জন্য মক্কায় গমন করবেন, তাদের জন্য মিকাত অতিক্রমের আগেই শুধু হজের নিয়তে ইহরাম বাঁধা ফরজ এবং মক্কা শরিফ পৌঁছে কেবল তাওয়াফে কুদুম বা আগমনী তাওয়াফ করা সুন্নাত। এ ছাড়া তারা জিলহজের ৮, ১০, ১১, ১২, ১৩ তারিখ হজের বাকি কাজগুলো হজে কিরান ও তামাত্তুর নিয়মে পালন করবেন। তবে কোরবানি করতে হবে না। কেননা ইফরাদ হজকারীদের জন্য কোরবানি নেই। এমনকি মক্কা শরিফ পৌঁছে তাওয়াফে কুদুমের পর ‘সাঈ’ করে থাকলে তাওয়াফে জিয়ারতের পর ‘সাঈ’ও করতে হবে না।