হারাধন বাবু। বয়স ৫০। শাঁখায় নকশা করাই যার পেশা ও নেশা। কাজ করেছিলেন আপনমনে বসে। উড়ে আসা শাঁখার গুঁড়ায় তার শরীরসহ চারপাশ সাদা হয়ে আছে। মাঝে মাঝে গামছা দিয়ে মুখটা মুছে নিচ্ছেন। বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বাটাজোড় শাঁখারিপাড়ার চিত্র এটি।
এ পাড়া শাঁখারিপাড়া নামেই পরিচিত। কারণ, শাঁখারি শিল্পীদের আকড়া এখানে। বসবাস কর্মসংস্থান আর রোজগারের কর্মযজ্ঞ চলে পুরো এলাকায়। তবে, আয়-বাণিজ্যে এখন কম। শিল্পীরা জানালেন, সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। পৈতৃক ব্যবসা না হলে ছেড়ে দিতেন অনেকেই।
হিন্দু নারীরা স্বামীর মঙ্গল কামনায় হাতে বালার মতো শাঁখা পরেন। এ ছাড়া বিভিন্ন পূজাতেও শঙ্খ দরকার। শুধু এই উপমহাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে নয়, ওলন্দাজ জাতিও শাঁখাকে পবিত্রতার প্রতীক মনে করে।
চতুর্দশ শতাব্দীতে রাজধানী ঢাকা হয়ে ওঠে শঙ্খশিল্পের প্রধান কেন্দ্র। তারপরই দেশের দক্ষিণাঞ্চল ছিল শঙ্খশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ। গত শতকের ষাটের দশকে ঢাকার তৎকালীন সিভিল সার্জন ও লেখক জেমস ওয়াইজ তার নোটস অন দ্য রেসেস, কাস্টস অ্যান্ড ট্রেডেস অব ইস্টার্ন বেঙ্গল বইয়ে লেখেন, ‘১৮৮৩ সালের দিকে পূর্ববঙ্গে মোট ২ হাজার ৭৩৫ জন শাঁখারি বাস করতেন। তার মধ্যে ঢাকায় বাস করতেন ৮৩৫ জন, আর বাকি ১ হাজার ৯০০ জন বাস করতেন বাখরগঞ্জ (বর্তমান বরিশাল) জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে।’
মূলত দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল বিভাগের গৌরনদী উপজেলা ও ঝালকাঠি জেলাতেই শঙ্খশিল্পের বিকাশ। কিন্তু এখানকার শাঁখা ব্যবসার সেই রমরমা অবস্থা আর নেই। শ্রীলঙ্কা থেকে শঙ্খ আমদানি বন্ধ হওয়াসহ নানা কারণে লোকজ এই শিল্প এখন বিলুপ্তপ্রায়।
বৃহত্তর বরিশালে গৌরনদী শঙ্খ ব্যবসার মূল ঘাঁটি। এখানে শাঁখারিদের গোড়াপত্তনের সঠিক সময় জানা যায়নি। স্থানীয় শাঁখারিদের ভাষ্য, কমপক্ষে ২০০ বছর আগে তাদের পূর্বপুরুষেরা ঢাকা থেকে এখানে এসেছেন।
একসময় এখান থেকে শাঁখা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলসহ ভারত, নেপাল, ভুটান, চীন, এমনকি আফ্রিকায়ও রপ্তানি হতো। এখন কেবল ঢাকা, খুলনাসহ বিভাগীয় শহরেই তাদের শাঁখার বিক্রি সীমাবদ্ধ।
১৯৭১ সালের আগে গৌরনদীতে কমপক্ষে ৬০টি শাঁখারি পরিবারের বাস ছিল। মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরে তাদের অনেকেই ভারতে চলে গেছে। বর্তমানে এখানে ১২টি পরিবার থাকলেও মাত্র ৫টি পরিবার শাঁখা তৈরি ও ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত আছে।
শাঁখা ব্যবসায়ীরা বলছেন, শ্রীলঙ্কা থেকে শঙ্খ আমদানি বন্ধ হওয়ায় ভারত থেকে শাঁখা আনতে খরচ বেশি পড়ে। তা ছাড়া শ্রম অনুযায়ী লাভ থাকে কম। পাশাপাশি নারীরাও এখন শাঁখা কম পরেন। শাঁখারিদের সন্তানেরাও লেখাপড়া শিখে পেশা বদলে ফেলছেন।
একাধিক শাঁখারিরা জানালেন, খুব সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কাজ করে দৈনিক ২৫০-৩০০ টাকা আয় হয়। মাস শেষে আয় ১০ থেকে ১৫ হাজারে সীমাবদ্ধ। নতুন প্রজন্ম কেউই এ পেশায় আসতে চায় না।
ঝালকাঠির শাঁখারিপাড়ায় পাকিস্তান আমলে ৩০-৩৫টি শাঁখারি পরিবারের বসবাস থাকলেও এখন টিকে আছে ১৫টি পরিবার। এখানে কেউ শাঁখা বানান না, তবে কয়েকজন নকশা করেন। তবে প্রতিটি পরিবারের কেউ না কেউ শাঁখা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত আছেন। বরিশাল সদরে শাঁখারিপাড়ায় আছে সাত-আটটি পরিবার।
১৯৫৬ সালে গঠিত বরিশাল শঙ্খশিল্প সমবায় সমিতির সম্পাদক বিজয় কৃষ্ণ দত্ত জানান, বৃহত্তর বরিশালে সমিতির ১৭৬ সদস্যের মধ্যে এখন ১০০ সদস্যের মতো আছে। কালের পরিক্রমায় আর নানা কারণে আজ বিলুপ্তপ্রায় দক্ষিণের শঙ্খশিল্প।