রাজশাহীর প্রধান অর্থকরী ফসল ‘আম’। এই তালিকায় কোনো অংশে কম নয় ‘পান’। কিন্তু আম ও পান ছাপিয়ে সম্ভাবনাময় আরেকটি ফল হিসেবে উঁকি দিচ্ছে ‘কলা’। নতুন করে আশা দেখাচ্ছে মার্কিন মুল্লুক দাপিয়ে ফেরা জি-নাইন বা গ্র্যান্ড নাইন জাতের এই কলা। পরীক্ষামূলকভাবে দেশে এই কলার চাষ করে কেউ কেউ সফলতাও পেয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মৌসুমে অন্তত ৫০০ কোটি টাকার কলা বাণিজ্য হয় রাজশাহীতেই। প্রচলিত জাতের এসব কলা চাষে বাজিমাত করেছেন এখানকার চাষিরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রপ্তানিযোগ্য জি-নাইন কলার বাণিজ্যিক চাষ ছড়িয়ে গেলে এই অঞ্চলের অর্থনীতির গতিধারা বদলে যাবে।
নগরীর রেলগেট এলাকায় জেলা কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তর। দপ্তরের আঙিনায় লাগানো হয়েছে কয়েকটি জি-নাইন জাতের কলাগাছ। সব কটি গাছেই কাঁদি এসেছে। নিরাপদ রাখতে কাঁদিগুলোতে পরানো হয়েছে ফ্রুটব্যাগ। এই উদ্যোগ নেন জেলার অতিরিক্ত উপপরিচালক (উদ্যান) উত্তম কুমার কবিরাজ।
জি-নাইন জাতের কলা নিয়ে কথা হয় এই কৃষি বিজ্ঞানীর সঙ্গে। তিনি বলেন, কলার এ জাতটি দেশে একদমই নতুন। এটি প্রচার হওয়ার অপেক্ষায়। সাধারণত দেশের বাইরে নাশতার সঙ্গে যে কলাগুলো লোকজন খায়, এটি সেই জাতের কলা। পুরোপুরি রপ্তানিযোগ্য কলার জাতও এটি।
এই জাতের কলার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি উচ্চ ফলনশীল। উত্তম কুমার কবিরাজ বলেন, বলা হয়ে থাকে, এই জাতের কলার একটি কাঁদি আড়াই মণ পর্যন্ত হতে পারে। কাঁদিতে ১৩ থেকে ১৫ ছড়ি কলা পাওয়া যায়। প্রতিটি ছড়িতে ১০ থেকে ১২টি করে প্রায় ২০০টি কলা পাওয়া যায় এক কাঁদিতে।
জি-নাইন জাতের কলা চাষ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই জাতের কলার চাষ প্রচলিত জাতের কলার মতোই। তবে টিস্যু কালচারের চারা হলে চারার বয়স নিশ্চিত হতে হবে। ল্যাবে চারার বয়স হয়ে গেলে জমিতে সেই গাছের আগেই ফলন চলে আসবে। ফলে কাঙ্ক্ষিত ফলন পাওয়া নিয়ে শঙ্কা থাকে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেক ল্যাবে এই চারা পাওয়া যায়। গাজীপুরের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও পাওয়া যাবে এ কলার চারা। আগ্রহীদের নিজ দায়িত্বে চারা নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
জি-নাইন কলায় চাষিরা বাড়তি লাভ করতে পারবেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, রাজশাহীতে স্থানীয় যেসব জাতের কলা চাষ হয়, সেগুলোর কাঁদি খুব একটা বড় করতে পারেন না কৃষকরা। সেখানে আমরা যদি চাষিদের সবরি কলা ও সাগর কলার পাশাপাশি জি-নাইন জাতের কলা চাষে উদ্বুদ্ধ করতে পারি, তাহলে একটি কাঁদি থেকে অন্তত হাজার টাকা আয় করতে পারেন চাষি। কম জমিতেও জি-নাইন কলা চাষে বেশি ফলন পাওয়া সম্ভব।
বাণিজ্যিক কলাচাষিদের ফ্রুটব্যাগ ব্যবহারের তাগিদ দিয়েছেন এ কৃষি বিজ্ঞানী। তিনি বলেন, বাজারে কলা কিনতে গিয়ে কলার গায়ে দাগ দেখলে সাধারণত ক্রেতারা কিনতে চান না। এই দাগ বিটল পোকার আক্রমণের দাগ। কলা যখন কচি অবস্থায় থাকে, তখন এই পোকা ত্বক কুরে কুরে খায়। কলা পরিপক্ব হওয়ার পর সেটি কালো দাগ ধারণ করে। এটির স্বাস্থ্যগত কোনো ঝুঁকি নেই। কিন্তু দেখতে খারাপ হওয়ায় চাষিরা দাম কম পান।
এই পরিস্থিতি থেকে কলাকে রক্ষায় ব্যাগিং করা যেতে পারে। মূলত কলা মোচায় থাকা অবস্থায় এই ব্যাগ পরাতে হয়। এতে বাড়তি কোনো কীটনাশক-ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হয় না। ব্যাগিং করা কলা একেবারেই চকচকে হয়। এই কলার বাজারমূল্য ভালো পাওয়া যায়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, ২০২০-২১ মৌসুমে রাজশাহী জেলায় কলাবাগান ছিল ১ হাজার ৯৭৩ হেক্টর। ৩২ দশমিক ২৮ টন থেকে বেড়ে গত মৌসুমে জেলায় কলা ফলেছে ৬৩ হাজার ৬৯৭ দশমিক ৫০ টন। ৪৩৭ হেক্টর বেড়ে চলতি ২০২১-২২ মৌসুমে জেলায় কলা চাষ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৪১০ হেক্টরে। এখান থেকে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার কলা পাওয়ার আশা চাষিদের।
সবচেয়ে বেশি কলার আবাদ হয় পুঠিয়া উপজেলায়। গত এক বছরে এই উপজেলায় চাষের পরিধি বেড়েছে ৩৫২ হেক্টর। গত মৌসুমে পুঠিয়ায় ৬৫০ হেক্টরে জমিতে কলাবাগান ছিল। তা থেকে ২১ হাজার ১২৫ টন কলা উৎপাদিত হয়েছে। এ বছর চাষ হয়েছে ১ হাজার ২ হেক্টর জমিতে।