চাঁদপুরের বিউটির ক্ষীর যাচ্ছে সৌদি আরবে

২০০৬ সালে অষ্টম শ্রেণিতে থাকতেই বিয়ে হয় বিউটির। কম বয়সে বিয়ে হওয়ার পরও হাল ছাড়েননি তিনি। সিদ্ধান্ত নেন, ব্যবসা করবেন। প্রথমেই নেমে পড়েন স্বামীর ক্ষীরের ব্যবসায় সহযোগিতা করতে। পরে প্রতিবেশী নারীদের নিয়ে গড়ে তোলেন একটি সমিতি। ঋণ নিয়ে ক্ষীর বানিয়ে তিনি আজ সফল। মাসে আয় করছেন ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা।

২০১২ সালে পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি) থেকে ১৫ হাজার টাকা ঋণ নেন বিউটি। তারপর পরিধি বাড়ান ক্ষীর ব্যবসার। শুরুতেই ক্ষীর বানিয়ে দেখেন লাভের মুখ। একসময় ভালো আয় হতে থাকে। এতে ফেরে সংসারের সচ্ছলতা।

ক্ষীরের ব্যবসা করে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি বিউটি কুড়িয়েছেন সুনাম ও পুরস্কার। উপজেলার সেরা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে পেয়েছেন জাতীয় পল্লী উন্নয়ন পদক। পেয়েছেন মহিলা অধিদপ্তর থেকে জয়িতা পুরস্কার।

সরেজমিনে বিউটির বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, লাকড়ির চুলায় বড় একটি কড়াইয়ে দুধ গরম করছিলেন বিউটি ও কয়েকজন নারী শ্রমিক। তৈরি করা ক্ষীর বাজারজাতের জন্য মাটির সানকিতে রাখছেন। আবার পাঠিয়ে দিচ্ছেন স্থানীয় বাজারে তাদের ‘আনন্দ দধি-ক্ষীর হাউস’ দোকানে। প্রবাসেও যায় তার বানানো ক্ষীর। দূরদূরান্তের মানুষ তার ক্ষীর কিনে নিয়ে পাঠিয়ে দেন প্রবাসে থাকা স্বজনদের কাছে।

তিনি জানান, তার পৈতৃক বাড়ি জেলা শহরের পুরানবাজার এলাকায়। ছোটবেলা থেকে অসচ্ছল পরিবারে বেড়ে ওঠেন। ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন তিনি। তার শৈশব কেটেছে অভাবে। ইচ্ছা ছিল পড়ালেখা করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার। কিন্তু আর্থিক সমস্যায় অষ্টম শ্রেণির পর আর পড়তে পারেননি। কিন্তু বিয়ের পর তিনি নিজেকে শেষ হতে দেননি। সব সময় তার মনে উদ্যোক্তা হওয়ার বাসনা ছিল।

উদ্যোক্তা বিউটি বলেন, কয়েক দফা ঋণ নিয়ে ক্ষীরের ব্যবসার পরিধি বাড়ান। এখন প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ কেজি ক্ষীর বানিয়ে বিক্রি করেন। মাসে গড় বিক্রি তিন লক্ষাধিক টাকা। লাভ থাকে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা। প্রতি কেজি ক্ষীর বানাতে ৩৫০ টাকা খরচ হয়। বিক্রি করেন ৪০০ টাকায়। ক্ষীরের ব্যবসা করে সাত শতক জমি কিনেছেন। সেখানে বাড়ি করবেন। সন্তানকে বানাবেন উচ্চশিক্ষিত।

তার বানানো ক্ষীর যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে, এ বিষয়ে বিউটি বলেন, প্রবাসে থাকা মানুষ বাড়িতে এলে আমাদের কাছে আসেন ক্ষীর কিনতে। তারা নিজেরা কিনে খান। আবার আত্মীয়স্বজনের জন্য নিয়ে যান। ছুটি শেষে প্রবাসে ফেরার সময় এসে বেশি করে কিনে নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে নিয়ে যান। কারণ, প্রবাস থাকা আত্মীয়রা তাদের কাছে অর্ডার পাঠান।

স্বামী উৎপল কুমার ঘোষ জানান, প্রথমে আমি একা ক্ষীরের ব্যবসা শুরু করি। পরে আমার স্ত্রীর সহযোগিতায় আমরা ব্যবসা বড় করেছি। গুণমান ঠিক রেখে ক্ষীরের ব্যবসা করে আজ সাফল্য অর্জন করতে পেরেছি আমরা।

চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলার ঐতিহ্যবাহী দুগ্ধজাত মিষ্টান্ন ক্ষীরের ইতিহাস শত বছরের। এখানকার ক্ষীর গুণেমানে সেরা এবং এর সুনাম ও ঐতিহ্য দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও আছে। মতলবের ক্ষীর চাঁদপুর, কুমিল্লা, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে যাচ্ছে। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকেও প্রবাসীরাও লোক মারফত ক্ষীরের ফরমাশ (অর্ডার) পাঠান এ উপজেলায়।

জানা গেছে, ইংরেজ শাসনামল থেকে শুরু করে এখনো এই ক্ষীরের চাহিদা এতটুকুও কমেনি। আগের তুলনায় এখন চাহিদা অনেক বেশি। উপজেলা প্রশাসন সম্পাদিত ‘মতলবের ইতিবৃত্ত’ বইয়ে এই ক্ষীরের উল্লেখ আছে। ২০১৩ সালে প্রকাশিত ওই বইয়ের ৪৪ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘মতলবের ক্ষীর খুবই প্রসিদ্ধ। সারা দেশে ক্ষীরের ব্যাপক চাহিদা ও কদরের কারণে এইখান অনেক হিন্দু পরিবার ক্ষীর তৈরি কাজে ব্যস্ত রয়েছে।

বিউটির বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে মতলব বাজরের রাস্তার পাশে নির্মল ঘোষের দেখা মেলে তার ছোট্ট পান-সিগারেটের দোকানে। সেখান কথা হয় তার সঙ্গে। এ ব্যবসার পাশাপাশি নির্মল দোকানে বিক্রি করেন ক্ষীরসহ অন্যান্য মিষ্টান্নসামগ্রী।

পরে তার ছেলে মোহন ঘোষ এই প্রতিবেদককে নিয়ে যান দাসপাড়া তাদের বাড়িতে। তাদের পরিবারে এক সদস্য একদিন ক্ষীরের দোকানে গিয়ে ২০০ টাকা দিয়ে ক্ষীর কিনতে চান। কিন্তু দোকানদার ২০০ টাকায় ক্ষীর বিক্রি করেননি। পরে ওই ক্ষোভ থেকে তারা নিজেরাই বাড়িতে শুরু করেন ক্ষীরের ব্যবসা।

মোহন ঘোষ বলেন, আমাদের পূর্বপুরুষরা ক্ষীরের ব্যবসা করত। এখন আমার বাবা এই ব্যবসা ধরে রেখেছেন। আমি ও আমার মা-দাদি ক্ষীর তৈরিতে বাবাকে সাহায্য করি। আমরা নিজেরাই বাজারজাত করি। আবার রাস্তার পাশে ফুতপাতে বসে ক্ষীর বিক্রি করি। আমাদের দৈনিক ২০ থেকে ৩০ কেজি ক্ষীর বিক্রি হয়।

তিনি আরও বলেন, নতুন ক্রেতা যখন আসে, তারা চান না আমাদের কাছ থেকে ক্ষীর কিনতে। আমি বলি, ভাই, রাস্তার ক্ষীরও ভালো হয়। একটু বিশ্বাস রাখুন। আমরা মাটির চুলায় ক্ষীর তৈরি করি। আমরা খুচরা বাজার থেকে দুধ কিনে থাকি তা বানাই।

আয় সম্পর্কে ঘোষ বাবু বলেন, মাসে আমাদের ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় হয়। তবে বিশেষ দিন উপলক্ষে ৫০ থেকে ৬০ হাজার আয় হয়। এখন প্রবাসীরাও আমাদের কাছ থেকে ক্ষীর কিনে নেন। ক্ষীর ফ্রিজে বেশি দিন থাকলে স্বাদ নষ্ট হয়ে যায় বলেও সতর্ক করে দেন ঘোষ।

স্থানীয়রা জানান, বিক্রেতারা প্রতিদিন সকালে গৃহস্থের কাছ থেকে খাঁটি দুধ সংগ্রহ করেন। অতঃপর সংগৃহীত দুধ বড় পাত্রে ঢেলে চুলায় একটানা দুই ঘণ্টা জ্বাল দেন এবং পাশাপশি তিনটি কাঠি দিয়ে পাত্রের তলদেশে বিচক্ষণতার সঙ্গে নাড়তে থাকেন, যেন পাতিলের তলায় পোড়া না লেগে যায়। অতঃপর দুধের রং পরিবর্তন হয়ে ক্ষীরে পরিণত হয়ে এলে তা মাটির ছোট ছোট পাত্রে আধা কেজি ও এক কেজি পরিমাপ করে আলাদাভাবে রাখেন। বিক্রির উপযুক্ত করার জন্য পাত্রের ক্ষীর কিছুক্ষণ ফ্যানের বাতাসে ঠান্ডা করে নেন।

এ এলাকায় দেখে হয় চট্টগ্রাম থেকে আসা ক্ষীর ক্রেতা সোলাইমানের সঙ্গে। তিনি জানান, মতলবের ক্ষীরের অনেক সুনাম শুনি। এটি খুবই সুস্বাদু। ভালো মানের। আমার বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের জন্য নিচ্ছি। আমাদের আত্মীয় স্বজনের বিদেশে পাঠাই।

স্থানীয় এক ক্রেতা বলেন, আমি এই ক্ষীর আগেও খেয়েছি। পরিবারের জন্য নিয়েছি। আমার অনেক বন্ধুবান্ধব বিদেশে থাকে। তাদের জন্য অনেক ক্ষীর পাঠিয়েছি। আমার জানামতে এখানকার ক্ষীর প্রধানমন্ত্রীও খেয়েছেন। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীরা তো সব সময় নিয়ে খান।

বোঝা গেল শুধু বিউটি বা নির্মল ও মোহন ঘোষরাই নন, ঘোষপাড়া এলাকার সুনীল ঘোষ, মিলন ঘোষ, গান্ধী ঘোষ, অনিক কুমার ঘোষ, উৎপল ঘোষ, নিবাস চন্দ্র ঘোষ, উত্তম ঘোষ এবং দাসপাড়ার মাখনলাল ঘোষ, নির্মল ঘোষসহ কয়েকটি পরিবার ক্ষীরের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।

সুনীল ঘোষ বলেন, এই ব্যবসা আমার দাদা করেছে, বাবা করেছে, আমরা এখন সম্পৃক্ত হয়েছি। আমি একবার ঢাকায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলাম। তখন ডাক্তার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার বাড়ি কোথায়? আমি বললাম, আমাদের বাড়ি চাঁদপুরের মতলবে। তিনি বললেন, মতলব ক্ষীরের জন্য বিখ্যাত। বুঝলাম সারা দেশে মতলবের ক্ষীরের সুনাম রয়েছে। আমরা এই ঐতিহ্য ধরে রাখব। আমাদের লাভ কম হলেও চলবে।

উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা আবুল হাসনাত বলেন, ঋণ নিয়ে বিউটি যেভাবে ক্ষীরের ব্যবসা করে স্বাবলম্বী হয়েছেন, তা একজন নারীর সক্ষমতা প্রমাণ হয়। এ জণ্য তিনি পেয়েছেন জাতীয় পল্লী উন্নয়ন পদক। আজ বিউটির দেখাদেখি স্বনির্ভর হয়েছেন বেকার অনেক নারী।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহমিদা জানান, মতলব দক্ষিণ উপজেলার ক্ষীরের শত বছরের ঐতিহ্য রয়েছে। বিআরডিবি থেকে ঋণ নিয়ে বিউটি রানী ঘোষ ক্ষীরের ব্যবসা করে আজ স্বাবলম্বী হয়েছেন। পেয়েছেন জাতীয় পল্লী উন্নয়ন পদক। আমরাও উপজেলা প্রশাসন থেকে তাকে সম্মননা প্রদান করেছি।

তিনি আরও বলেন, যেসব নারী এই ব্যবসার ও উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিশাল একটা কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। এখানে ক্ষীর ব্যবসায়ী যারা আছেন, আমরা সব সময় তাদের অনুপ্রাণিত করে আসছি। মতলবের ক্ষীর মধ্যপ্রাচ্যেও রপ্তানি হচ্ছে। আরও ব্যাপক আকারে রপ্তানি বাড়ানোর জন্য সরকার উদ্যোক্তাদের প্রণোদিত করবে।

নিউজটি শেয়ার করতে নিচের বাটনগুলোতে চাপ দিন

Facebook
Twitter
WhatsApp
LinkedIn
Print

আপনার মতামত প্রকাশ করুন

এ বিভাগের আরো খবর

ফেসবুক পেজে লাইক দিন

বিভাগীয় সংবাদ