দুইমাসের বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা বর্বরোচিত বিমান হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। স্থল পথেও সেনা অভিযান চলার কারণে ভূখণ্ডটিতে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র মানবিক সংকট। পরিস্থিতি এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, গাজার মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই থাকছেন অনাহারে।
জাতিসংঘের একজন ঊর্ধ্বতন ত্রাণ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে রোববার (১০ ডিসেম্বর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
গাজার পরিস্থিতি কতটা ভয়বহ সেটি বোঝাতে গিয়ে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) উপপরিচালক কার্ল স্কাউ বলেছেন, প্রয়োজনের তুলনায় ত্রাণসহায়তার ক্ষুদ্র অংশ সেখানে ঢুকতে পারছে, ফলে সেখানকার প্রতি দশজন বাসিন্দার নয়জনই প্রতিদিন খাবার পাচ্ছেন না।
চলমান পরিস্থিতিই গাজায় ত্রাণ সরবরাহ ‘প্রায় অসম্ভব‘ হয়ে পড়েছে, বলেন স্কাউ।
গাজা থেকে হামাস সদস্যরা গত ৭ অক্টোবর কঠোর নিরাপত্তার সীমান্ত ভেদ করে ইসরায়েলের ভেতরে ঢুকে হামলা চালিয়ে ১২০০ মানুষকে হত্যা ও ২৪০ জনের মতো মানুষকে বন্দি করে নিয়ে যায়।
এর পাল্টায় ইসরায়েল গাজার সঙ্ড়েগ সীমান্ত বন্ধ করে দিয়ে সেখানে টানা বিমান হামলা শুরু করে। সে সময় থেকেই জায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের সরবরাহ কঠিন হয়ে পড়ে। গাজার বাসিন্দারা এই সয়তার ওপরই নির্ভরশীল।
শুধুমাত্র মিশরের সঙ্গে যুক্ত রাফাহ ক্রসিংই খোলা রয়েছে, যে পথে প্রতিদিন সীমিত ত্রাণ সহায়তা ঢুকছে গাজায়।
ইসরায়েল আগামী কয়েকদিনের মধ্যে কেরেম শালোম ক্রসিং খুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, তবে সেটি কেবল ত্রাণবাহী ট্রাকগুলো পরিদর্শনের জন্য। পরিদর্শনের পরই ট্রাকগুলোকে রাফাহ ক্রসিং দিয়ে গাজায় ঢুকতে দেওয়া হবে।
কার্ল স্কাউ বলেছেন, চলতি সপ্তাহে তিনি এবং তার দলটি গাজায় ঢুকে যে ধরনের ‘আতঙ্ক, বিশৃঙ্খলা আর হতাশাজনক‘ পরিস্থিতির মুখে পড়েন, তার জন্য তারা মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না।
“(পণ্যের) গুদামগুলোতে এলোমেলো অবস্থা, ত্রাণ বিতরণের জায়গাগুলোতে হাজারো মানুষের গাদাগাদি, সুপার মার্কেটগুলোতে শুন্য তাক এবং অশ্রয়কেন্দ্রেগুলোর বাথরুমে পর্যন্ত উপচে পড়া মানুষ, এমন পরিস্থিতি দেখতে হয়েছে,“ বিবিসিকে এমনটাই বলছিলেন স্কাউ।
গত মাসে এক সপ্তাহের সংক্ষিপ্ত যুদ্ধবিরতি এবং আন্তর্জাতিক চাপে গাজায় কিছু ত্রাণ সহায়তা ঢোকে। কিন্তু ডব্লিউএফপি এখন গাজার বাসিন্দাদের চাহিদা পূরণে আরেকটি সীমান্ত ক্রসিং খোলার কথা বলে আসছে।
ডব্লিউএফপি কর্মকর্তা স্কাউ বলেন, “সেখানে এখন প্রতি দশটি পরিবারের মধ্যে নয়টিই পুরো একটি দিন ও রাত না খেয়ে থাকছে।“
বর্তমানে ইসরায়েলের দুটি ট্যাংক বহর ঘিরে রেখেছে গাজার খান ইউনিস এলাকা। সেখানকার পরিস্থিতিও ভয়াবহ।
সেখানে টিকে একমাত্র স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র নাসের হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি ও বার্ন ইউনিটের প্রধান ডা. আহমেদ মোগরেব খাদ্যের হাহাকার নিয়ে বিবিসির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন।
“আমার তিন বছরের একটি মেয়ে আছে। সে সব সময় আমার কাছে মিষ্টি, আপেল কিংবা কোনো ফল খেতে চায়, আমি দিতে পারি না। আমি অসহায়। এখানে পর্যাপ্ত খাবার নেই। শুধু চাল, শুধু চাল আছে। বিশ্বাস হয়? আমরা শুধু দিনে একবার খাই।“
গত কয়েকদিন ধরেই ইসরায়েলের বিমান হামলার অন্যতম লক্ষ্য এই খান ইউনিস। নাসের হাসপাতালের প্রধান জানিয়েছেন, যেভাবে মৃত আর আহতদের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে তারা কিছুই আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না।
ইসরায়েলের দাবি, হামাস সদস্যরা খান ইউনিসে, বিশেষ করে সেখানকার ভূগর্ভস্থ টানেলগুলোতে লুকিয়ে আছে। আর তাই হামাসের সামরিক শক্তি ধ্বংসে সেখানে ঘরে ঘরে আর আনাচে-কানাচে যুদ্ধ চালাতে হচ্ছে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল রিচার্ড হেক্ট বিবিসিকে বলেছেন, “একজন বেসমারিক নাগরিকের মৃত্যু এবং কষ্ট দেখাটাও বেদনাদায়ক, কিন্তু আমাদের কোনো বিকল্প নেই।“
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ইসরায়েলের হামলায় এ পর্যন্ত সেখানে ১৭ হাজার ৭০০ জন নিহত হয়েছে, যার মধ্যে ৭ হাজারই শিশু।
এমন যখন পরিস্থিতি, ঠিক সে সময়ে জাতিসংঘের নিরাপদত্তা পরিষদে গাজায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতির এক প্রস্তাবে ভিটো দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের এই ভূমিকাকে ‘যুদ্ধাপরাধ‘ বলছেন ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস।
‘(ইসরায়েলি) দখলদার বাহিনীর হাতে গাজায় ফিলিস্তিনি শিশু, নারী এবং বৃদ্ধদের রক্তপাতের জন্য ওয়াশিংটনকে দায়ী‘ করেন তিনি।
অন্যদিকে, নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র ‘সঠিক অবস্থান‘ নিয়েছে বলে প্রশংসা করেছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।